মাসজিদ কথন

শরতের শেষ বিকেল।  নদীর ধারে বসে বসে বাতাস খাচ্ছি। একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম।

-কী অবস্থা? কেমন আছো?

ডাক শুনে পাশ ফিরলাম। দেখি  শামীমের আব্বু।  কোলে একটা পিচ্চি। ৭/৮ মাসের মতো হবে মনে হয়।

শামীম হলো আমাদের ২ বাড়ির পরের বাড়ির ছেলে।  আমার চাইতে ৪/৫ বছরের ছোট হবে। কুশল বিনিময় শেষে জানতে চাইলাম- পিচ্চিটা কে, কাকু?

-এটা শামীমের ছেলে। হাসিহাসি মুখে জানালো শামীমের আব্বু।

আমার মুখটাও হাসিখুশি হয়ে গেল।

বাহ! এতো অল্প বয়সেই শামীম বাচ্চার বাপ হয়ে গেল। পিচ্চিকে কোলে নিলাম। এবং কোলে এসেই পিচ্চিটা প্রথম যে কাজ করল তা হলো আমার দাঁড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারা। অস্ফূট একটা আর্তনাদ বের হলো আমার মুখ থেকে। ভয় পেয়ে গেল পিচ্চি। ট্যাঁ ট্যাঁ করে  চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। সেই সাথে সজোরে নিচের কল ছেড়ে দিল।  দুই-তিন সেকেন্ডের মধ্যেই যা ঘটার ঘটে গেল। আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

নাহিদের আব্বু কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মজা পেয়েছে মনে হয়। এগিয়ে এসে আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। শামীমের পিচ্চির চেহারা অনেকটাই শামীমের মতো। শামীমের ছেলেবেলার কিছু  উরাধুরা স্মৃতি মনে পড়ে গেল।  স্মৃতিগুলো যে কেমন তা তোমরা শুনলেই বুঝতে পারবে।

শামীমের ছোটবেলার চেহারা ও পোশাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা আগে দিয়ে নেই। তাহলে তোমরা বুঝতে পারবে যে ওর দ্বারা আসলে কী কী করা সম্ভব!

ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই প্রথমে যে চেহারা ভাসে তা হলো ও একটা কালো রঙের হাফপ্যান্ট পরে আছে। হাফপ্যান্টের পোস্ট অফিস অবশ্য  খোলা।  আর নাক দিয়ে   সর্দি ঝুলে আছে। একটু পর পর সে সুড়ুৎ করে ভেতরে টেনে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে খেয়াল থাকে না ওর অবশ্য। সর্দি বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকে অনেকক্ষণ।  কেউ মনে করিয়ে দিলে সে সেটা ভেতরে টেনে নেয়। [তবে আমি চুপে চুপে একটা কথা বলি তোমাদের। শামীম যেন না জানে। আমি নিজের চোখে দেখেছি দুই-তিনবার সর্দি তাঁর নিজের মুখে ঢুকে গিয়েছে। সে জিহ্বা বের করে চাটছে।]

শামীম কে নিয়ে আমরা ম্যাজিক দেখাতাম এলাকায় নতুন কেউ বেড়াতে আসলে। ও ছিল ধবধবে সাদা। কিন্তু ধুলোয় এতোই গড়াগড়ি করত আর রোদে এতোই ঘুরত যে তোমরা দেখলে ভাববে এ বোধহয় এখনই আফ্রিকার বিমান থেকে নেমেছে। আমরা গোসল করতাম বিশাল একটা দিঘীতে। এলাকায় নতুন কোনো পিচ্চি আসলে গোসল করার সময় ওকে বলতাম- দেখ, তোকে একটা ম্যাজিক দেখাই। এই যে দেখছিস, শামীম, কালো কুচকুচে। ওকে আমরা একটা দুআ পড়ে ফুঁ দিব আর সে ফর্সা হয়ে যাবে। এরপর সবাই মিলে শামীমের গা কচলানো শুরু করতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ময়লা সরে গিয়ে ওর গায়ের আসল রঙ বের হয়ে যেত। আর আমরা ম্যাজিক দেখানোর  সেই ভাব নিতাম।

শামীমের ব্যাপারে পাড়ায় সবচেয়ে প্রচলিত যে কথা ছিল তা হচ্ছে সে এই ৫/৬ বছর বয়সেই একটা পেয়ারার বাগান করে ফেলেছে। হেগে হেগে! অবাক হইওনা। তুমি ঠিকই পড়েছ।  খুলেই বলি তাহলে।

আমাদের বাসায় ছিল দেশী পেয়ারার বিশাল একটা গাছ। সারারাত ধরে পাকা পেয়ারা খসে খসে পড়ত আমাদের উঠানে। ঘুম থেকে উঠে শামীমের প্রথম কাজ ছিল চোখ মুছতে মুছতে আমাদের বাসায় আসা। কখনও এমন হয়েছে যে  সে একেবারে বিছানা থেকে উদোম গায়ে এসে হাজির। আমার দাদি শামীমকে বেশ স্নেহ করত। দাদি পাকা পাকা পেয়ারাগুলো তার জন্য রেখে দিত। সে বারান্দায় বসে বসে খেত যতক্ষণ পারে। এরপর গিয়ে হাজির হতো আমাদের বাড়ির পেছনের একটা পরিত্যাক্ত মাঠে। সেখানে বসে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিত। একেকদিন এক এক স্থানে। এরপর বর্ষাকাল আসলো।

ওর ঐ বিশেষ জিনিসগুলোর সাথে পেয়ারার বিচি মাটিতে মিশে গিয়েছিল। বর্ষার বৃষ্টিতে এই বিচিগুলো থেকে গাছ বের হলো। ঐ এলাকা ছেয়ে গেল পেয়ারার গাছে। পুরো বাগান হয়ে গেল। উহু, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ঐ গাছগুলো বেশ কয়েকমাস ছিল। এরপর একটা গরু ঢুকে একদিন সবগুলো গাছ সাবাড় করে দেয়।

আশা করি শামীমের যে লম্বা পরিচয় দিলাম তাতেই তোমরা বুঝতে পারছ সে কেমন উস্তাদ ছিল। তবে তার তেলেসমাতি মাসজিদে নামাজ পড়তে গেলে অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত। এত ঘটনা যে মনে পড়ছে! কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। দাঁড়াও আগে কিছুক্ষণ হেসে নেই।

২০/২২ বছর আগের ঘটনা। সে সময় ছোট বাচ্চাদের [বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের] ফুল প্যান্ট কালেভদ্রে কিনে দেওয়া হতো। নামাজ পড়তে বা সকালে মক্তবে যাওয়ার জন্য চক্রাবক্রা লাল-নীল বিভিন্ন লুঙ্গিই ছিল সঙ্গী। শামীম এমনই লুঙ্গিই পরে নামাযে আসত। ওর বাসা মাসজিদের কাছেই ছিল। একা একাই যেত। একবার গরমের ছুটিতে অনেক দিন মামার বাসায় ছিলাম। শামীমের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। বাসাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। শুক্রবার ছিল। তড়িঘড়ি করে মাসজিদে গেলাম।

মাসজিদে সাধারণত বড়রা যেটা করেন তা হলো সকল পিচ্চিদের স্ক্যান করে পিছনের কাতারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  তো এমন স্ক্যানিং এর চক্করে পড়ে আমি হাজির হলাম একেবারে শেষ কাতারে। বামপাশের কোণায়। সেখানেই শামীমের সাথে দেখা। নামায ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সে আমাকে দেখেই মহাখুশি। চিৎকার দিল- আরে ভাইয়া!! তুমি কখন এলে? আমি কোনোমতে তাকে শান্ত করে নামাজ শুরু করলাম।

সে উশখুশ করতে করতে নামাযের হাত বাঁধলো। কিন্তু সে নামাজে মন বসাতে পারছে না। আমি এতদিন কোথায় ছিলাম, কী করলাম, দুপুরে আজকে কোন বাংলা ছবি হবে এসব প্রশ্ন জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রইল। সে এদিক ওদিক দুলছে। ওর ঐ পাশের পিচ্চিটা তার এই দোলাদুলুনিতে মজা পাচ্ছে। ওর গায়ে ধাক্কা লাগছে। আবার সেও শামীমকে ধাক্কা দিচ্ছে। হালকা করে হাসির হিড়িক উঠেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতর থেকে আমারও হাসির বুদবুদ উঠছে। বহুকষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখে নামাযে মন দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্ত ধাক্কাধাক্কি চলছেই।   তো এভাবে ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে শামীমের লুঙ্গি খুলে আশ্রয় নিল সোজা মেঝেতে। পাশের পিচ্চিটা হো হো করে হেসে উঠল। কয়েকজন পিচ্চি কাতার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। আমি বহু কষ্টেও হাসি থামাতে পারলাম না। সালাম ফেরানোর পরেই দুরদুর করে সবাই বাহিরে দৌড় দিলাম। পেছন থেকে বড়দের হুমকি ধামকি ভেসে আসছে।

এই লুঙ্গি নিয়েই আর একটা ঘটনা। জুমার ফরজ নামায শেষে মাসজিদের বারান্দায় সুন্নত পরে বসে আছি। শামীম আমার পাশে এসে নামাযে দাঁড়িয়েছে [নামাযে দাঁড়ানো মানে আর কি… এদিক সেদিক তাকাবে, চোখাচোখি হলে হাসবে, তারপর যখন মনে হবে যে না অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা হলো আর না, তখন টকাস করে একটা সিজদাহ দিবে]। মাসজিদের মাঠে কিছু রাজহাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। আর ডাকাডাকি করছে। আমাকে মাসজিদের খাদেম বলল- যাও তো কাকু, হাসগুলো তাড়িয়ে দাও। মুসল্লিদের সমস্যা হচ্ছে।

আমি বারান্দার রেলিং টপকে  হাঁস তাড়াতে গেলাম। শামীম আমাকে দেখে নামায ফেলে দৌড় দিল। সেও হাঁস তাড়াবে। সেও আমার মতো বারন্দার রেলিং টপকে আসার জন্য লাফ দিল। লাফটা ঠিক যুতসই হলো না (ছোট মানুষ আর কতো জোরে লাফ দিতে পারবে!) মাঝপথে রেলিং এর সাথে ওর লুঙ্গি জড়িয়ে গেল। দু সেকেন্ড সে রেলিংয়ের সাথে আটকে থাকল। এরপর দেখা গেল – তার লুঙ্গি রেলিং এ আটকে আছে। বাতাসে উড়ছে। আর সে বারান্দায় শুয়ে আছে । ব্যথায় কান্না শুরু করে দিয়েছে!

শবে কদরের[1] রাতে  আমরা দলবেঁধে মাসজিদে যেতাম নামায পড়তে। নামায পড়া আর কিসের কি এর চাইতে বেশি হতো ভূতের গল্পের আসর, পুরো এলাকায় ঘোরাঘুরি করা বা দুই-চার রাকাত নামায পড়েই মাসজিদের মেঝেতে ঘুমিয়ে যাওয়া। সেহেরীর সময় মাসজিদে হাঁসের মাংশের খিচুরী দিত। সেটাও ছিল অন্যতম আকর্ষণ। তো একবার শবে কদরের রাতে দেখি আমার পাশ থেকে হিসুর গন্ধ আসছে। ব্যাপার কী!  পরে দেখি যে শামীম ঐখানে ঘুমিয়ে আছে আর সে সুন্দর মতো ঘুমের ঘোরে হিসু করে দিয়েছে!! গন্ধে গন্ধে খাদেম এসে হাজির। তারপরের ঘটনা আর নাই’বা বলি।

এতসব কাণ্ডকারখানার পরেও শামীম মাসজিদে মাঝে মাঝেই নামাযে যেত। শুক্রবার ছাড়াও। তবে এবার ওর মাসজিদ ছাড়ার ঘটনাটা বলি। হেগে হেগে পেয়ারার বাগান বানানোর পরের বছরের ঘটনা। গ্রীষ্মকাল চলছে। যুহরের ওয়াক্ত। প্রচণ্ড গরম মাসজিদে। শামীম যথারীতি লুঙ্গি পরে হাজির মাসজিদে। খাদেমের সাথে ওর ভালোই সুসম্পর্ক (!) ছিল আগেই বলেছি। ও মাসজিদে ঢুকতেই খাদেম কি জানি বলল ওকে। ওর চেহারাটা কালো হয়ে গেল দেখলাম। মাসজিদের বারান্দায় আমি বসে ছিলাম। আমার সাথে দুই একটা কথা বলে সে মাসজিদের ভেতরে চলে গেল। একটু পর মাসজিদের ভেতর থেকে বেশ হইচই শোনা গেল। গিয়ে দেখি সবাই মিলে শামীমকে ধমকাচ্ছে।  কাহিনী হলো- খাদেম সুন্নত নামায পড়ছিল। খাদেম যেই সিজদাহ দিতে গিয়েছে, শামীম সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাতদেশে চাটি মেরেছে!

ইমাম সাহেব শামীমকে সে যাত্রায় বাঁচালেন। ছোট মানুষ, ভুল করে ফেলেছে।

কিছুক্ষণ পরে জামাআত শুরু হলো। আমি একেবারেই কাতারের বামপাশে। আর আমার পাশে শামীম। নামায শুরু হতেই সে নামায ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। এরপর মাসজিদের বিভিন্নস্থান থেকে ধুপধাপ আওয়াজ ভেসে আসল। এবং এর একটু পরেই মাসজিদের সব ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল। লাইট ঠিকই জ্বলছিল। কিন্তু ফ্যান বন্ধ। গরমে ঘেমে একেবারে গোসল করার মতো অবস্থা আমাদের। অনেক কষ্টে নামায শেষ হলো। এরপর ফ্যান বন্ধ হবার আসল কারণ জানা গেল।

সবাই শামীমকে ধমকাধমকি করায় সে রাগ করে সবগুলো ফ্যান বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে। যাবার আগে মাসজিদের ছোট ছোট টাকা সংগ্রহের বাক্সগুলোতে বালি ভরে দিয়েছে! [2]

এরপর শামীমকে আর তেমন মাসজিদে দেখিনি। বড় হবার পরেও ওকে কালেভদ্রে মাসজিদে দেখা যায়। এমন শামীম হয়ত আমাদের দেশের প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় আছে।

দুই.

আমাদের দেশের মাসজিদগুলোতে সাধারণত বাচ্চাদের স্বাগতম জানানো হয় না। বাচ্চারা মাসজিদে নামায পড়তে গেলেই মুসল্লিদের সালাত নষ্ট হবে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে পরিবেশ নষ্ট করবে এমন ধারণা করা হয়। অনেক বাচ্চাই আসলে মাসজিদে গেলে দুষ্টুমি করে। তাদের এই বয়সটাই চঞ্চলতার, দুষ্টুমি করার, মাঠে-ঘাটে ছোটাছুটি করার।

মাসজিদে শিশুদের সালাতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ইসলাম কী বলে?

নামায ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। হাশরের ময়দানে নামাযের হিসাব নেওয়া হবে সবার আগে। তাই সন্তানদের নামাযি করে তোলার জন্য  মুহাম্মাদ  ﷺ সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ﷺ  বলেন, ‘সাত বছর বয়স হলে শিশুকে সালাতের আদেশ দাও, দশ বছর হলে চাপ সৃষ্টি করবে, প্রয়োজনে মৃদু প্রহার করবে’।[3]

বাচ্চাদের নামাযি বানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হতে পারে মাসজিদে নিয়ে যাওয়া।

কাতাদা রা. বলেন, ‘মাসজিদে বসে আমরা নামাযের অপেক্ষা করছিলাম। রাসূলে কারীম ﷺ তখন আপন নাতি উমামা বিনতে যাইনাব রা.-কে নিয়ে আসেন। তিনি নবি ﷺ এর কোলে ছিলেন। তাঁকে কাঁধে নিয়েই তিনি  নামাযের ইমামতি করেন। রুকুতে যাওয়ার সময় তাঁকে জমিনে রেখে দিতেন। সিজদাহ থেকে উঠে তাঁকে আবার কাঁধে নিয়ে নিতেন।[4]

আমরা শিশুদেরকে মাসজিদে নিয়ে আসতে নিষেধ করছি, বাধা প্রদান করছি। কিন্তু রাসূল ﷺ শিশুকে মাসজিদে নিয়ে এসে, তাও আবার মেয়ে শিশুকে, একেবারে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করছেন।

এবার একটু ভিন্ন হাদীস উল্লেখ করছি। আবূ হুরাইরা রা. বলেন, ‘রাসূল ﷺ মাসজিদে নববিতে নামাযের ইমামতি করছিলেন। একজন শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত সুরা দিয়ে নামায শেষ করে দেন’।[5]

অন্য একটি হাদীসে উল্লেখ আছে, আয়িশা রা. বলেন, ‘কোনো একদিন ইশার নামায পড়াতে আসতে নবি ﷺ একটু দেরি করেন। ফলে মাসজিদে উপস্থিত শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে।[6]
এই হাদীসগুলো থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মুহাম্মাদ ﷺ -এর মাসজিদে শিশুদের প্রবেশাধিকার ছিল।

বাবা-মার দায়িত্ব

বাবা-মার দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে ভালো মতো নাসীহাহ দেওয়া। মাসজিদের আদব শিখিয়ে দেওয়া। নামাযের নিয়ম-কানুন শেখানো। মাসজিদে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করা যাবে না, নামায ছেড়ে এদিক সেদিক যাওয়া যাবে না, কেউ নামায পড়লে তার সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না, নামায চলাকালীন এদিক ওদিক তাকানো যাবে না, হিসু করে দেওয়া যাবে না… ইত্যাদি। যদি নিশ্চিত হন যে সে চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না কিন্তু হিসু করে দিতে পারে তাহলে  ডায়াপার পরিয়ে নিয়ে যান।  কাতারের একটা সাইডে দাঁড়ালেন। তবে যদি একেবারেই অবুঝ বাচ্চা হয় তাহলে মাসজিদে না নিয়ে যাওয়াই উত্তম।

আর একটি কথা, যদি মাসজিদে গিয়ে আপনার শান্তশিষ্ট বাবু  হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং মুসল্লিদের বকাঝকা সহ্য করতে হয়  তাহলে বাসায় এসে বাবুকে বকাঝকা করবেন না। এতে তার মেধাবিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হবে। মাসজিদের প্রতি তার একটা ভীতি তৈরি হবে। সে বড়  হলেও মাসজিদে যেতে চাইবে না।

তোমাদের দায়িত্ব

তোমরা  মনে হয় না এই বয়সে এসে আর দুষ্টামি করো। কেউ করে থাকলে এখন থেকেই বাদ দিয়ে দাও। মাসজিদে বসে বসে ফ্রি ফায়ার, পাবজি খেলবে না। মাসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে ভাই।পাশাপাশি তোমাদের আরও অনেক  অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-

১। তোমরা আর কিছু সময়ের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্‌। সমাজ তোমাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করবে। তোমরাই আস্তে আস্তে মাসজিদের দায়িত্বগুলো বুঝে নিবে। সে সময় মাসজিদের মেহমান শিশুদের প্রতি তোমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেটা জেনে  রাখ।

২। তোমাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে ইমাম সাহেব বা মাসজিদ কমিটির  কাছে যেতে পারো। বড়দের মাধ্যমে সুন্দর করে বিষয়গুলো আলোচনা করতে পারো।

৩। মাসজিদে কোনো বাবুকে বকাঝকা করতে দেখলে তাকে আগলিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। বড়দের সাথে আবার বেয়াদবি করে বসো না। আংকেল, ছোট বাচ্চা বোঝে নাই, মাফ করে দেন। সামনে থেকে আর এমন করবে না…। বকা খাওয়া বাবুকে বাহিরে নিয়ে গিয়ে চকলেট কিনে দিতে পারো। বা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করলেও সে খুশি হয়ে যাবে।

৪। মাসজিদে আসা বাচ্চাদের একত্রিত করে সুন্দর করে তাদের মাসজিদের আদবগুলো বুঝিয়ে দিতে পারো। আমি এটা দেখেছি বেশি ধমকাধমকি করলেই বাচ্চারা বেশি দুষ্টুমি করে। একটু সুন্দর করে  বোঝালেই ওরা বুঝে। এছাড়া বন্ধুরা সবাই মিলে পিচ্চিদের কাতারের মাঝে মাঝে নিয়ে দাঁড়াবে। ওদের একসাথে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিবে না। এতে বেশি দুষ্টুমি করে।

৫। তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলো। গল্প করো। বন্ধুরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে ওদের মাঝে মাঝে চকলেট বা চিপস কিনে দিলে। ওদের সাথে একটু খেলাধুলা করলে মাসজিদের বাহিরের মাঠে বা অন্য কোথাও। ওদের মাসজিদে আসাকে আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করলে। মনে রাখবে ভাই, তোমার এই সামান্য প্রচেষ্টাটুকু হতে পারে তোমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগের মধ্যে একটি।

মুহাম্মাদ ﷺ এর মাসজিদ, মাসজিদে নববি বা অন্যান্য দেশের মাসজিদগুলোতে বাচ্চারা মাসজিদে এসে অত্যন্ত আনন্দময় অভিজ্ঞতা লাভ করে। পরবর্তী নামাযি প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য এটা আসলে অনেক দরকারী।  ছোট বয়সেই মাসজিদ সম্পর্কে ভীতি বা বিরূপ ধারণা তৈরি হলে পরবর্তীতে তা দূর করা আসলে অনেক কঠিন হয়ে যায়। আবার বিপরীতটাও সত্য।  শিশুকালে মাসজিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠলে  পথ ভোলার সম্ভাবনা কমে আসে অনেক।  একটা প্রবাদের মতো কথা আছে। যদি মাসজিদের পেছনের কাতার থেকে বাচ্চাদের হাসাহাসির  শব্দ না পাওয়া যায় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চিন্তিত হবার সময় চলে এসেছে।

মাসজিদ কমিটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে নামাযির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে চাইলেই-

১। একদিন এলাকার সব পিচ্চিদের একত্রিত করে  মাসজিদের নিয়ম-কানুনগুলো শিখিয়ে দেওয়া। সাথে নামাযের নিয়ম কানুনও। তাদের দুষ্টুমি অনেক কমে যাবে ইনশাআল্লাহ।

২। সবাইকে একদম পেছনের কাতারে দাঁড় না করিয়ে বড়দের কাতারের মাঝে মাঝে দাঁড় করানো।

৩। মাসজিদে শিশুদের উপস্থিতিতে মুসল্লিদের দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ খুতবায় বুঝিয়ে দেওয়া।

৪। বাচ্চারা একটু দুষ্টুমি করতেই পারে এতকিছুর পরেও। তাদেরকে বকাঝকা না করা। বকাঝকা করলে তারা আর মাসজিদে আসবে না। এছাড়া মাসজিদে এভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাচ্চাদের বকাবকি করলে অন্য মুসল্লিদেরও নামাযে সমস্যা হয়। এর চেয়ে বরং বাচ্চাদের অভিভাবককে ডেকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিন। সন্তানের সামনেই অভিভাবকদের অপমান করবেন না। আমাদের নিজেদেরও অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠে। উচ্চস্বরে কথা বলে উঠি।

পরবর্তী প্রজন্মকে নামাযি বানানোর  গুরুদায়িত্ব আমাদের ঘাড়েই। কাজেই এই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। মাথাব্যথা করলে আমরা মাথা কেটে ফেলি না। কিছু বাবু দুষ্টুমি করে বলে সকল বাবুর জন্য মাসজিদে প্রবেশ নিষেধ করে দিলাম বা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করলাম যে, কোনো বাবুই আর মাসজিদে আসতে সাহস পাচ্ছে না, তাহলে সেটা মুহাম্মাদ ﷺ কে অনুসরণ করা হবে না। তাঁর বিরোধিতা করা হবে। 

আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশের অনেক মাসজিদেই বাচ্চাদের মাসজিদমুখী করার জন্য সুন্দর সুন্দর প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। যেমন-

১। ৪০ দিন জামাআতে টানা নামাজ পড়লে সাইকেল, ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট … ইত্যাদি বিভিন্ন উপহার দেওয়া।

২।  মাসজিদে নামায পড়তে গেলেই চকোলেট উপহার দেওয়া।

৩।  মাসজিদকেন্দ্রিক পাঠাগার, খেলাধুলা, বনভোজন ইত্যাদির আয়োজন করা।

এসমস্ত উদ্যোগ অত্যন্ত আনন্দের জন্ম দেয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমরা আন্তরিকভাবেই দুআ করি শিশুদের মাসজিদমুখী করার এই আয়োজনগুলো আল্লাহ তাআলা কবুল করে নিন। এমন উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের প্রতিটি মাসজিদে।

ষোলো হিসেবে তোমরাও কিন্তু তোমাদের মাসজিদে এমন আয়োজন করার উদ্যোগ নিতে পারো। আমরা বরাবরের মতোই তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। তোমরা এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে প্রস্তাব দাও। ষোলোদের পদচারণায় আমাদের মাসজিদগুলো প্রাণ ফিরে পাক, গড়ে উঠুক বাতিঘর হিসেবে। আজ এ পর্যন্তই। টা …টা…


[1] সম্ভাব্য রাত

[2] সত্য ঘটনা অবলম্বনে, ঈষৎ পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত, ছদ্মনামের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে

[3] সুনানে আবী দাউদ ৪৯৬, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৩৫০১, মুসনাদে আহমাদ ৬৬৮৯

[4] সহিহ বুখারী: ৫১৬, সহীহ মুসলিম ৫৪৩

[5] মুসনাদে আহমাদ: ৯৫৮১

[6] সহিহ বুখারী: ৫৬৬, সহীহ মুসলিম ৬৩৮


Posted

in

by

Tags: