আমরা দেখেছি, ‘১৮ এর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা ‘২৪ এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়গুলোতে দেশের বীর সন্তানেরা কীভাবে সাগ্রহে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সড়ক ও যানবাহন-ব্যবস্থার নিরাপত্তার সাথে নিজেদের যুক্ত করেছিল। তাদের অংশগ্রহণ এবং সড়ক-অনিয়ম নিয়ে অফিস কলিগদের সাথে বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্ব ও নিরাপদে সড়ক ব্যবহারে তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ববোধ নিয়ে কিছু লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। শিরোনাম পড়ে ‘রসকষহীন কিছু আলোচনা’ মনে হলেও লিখাটা সহজবোধ্য রাখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
Road Traffic Safety Awareness বা সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা তোমার-আমার সবার জন্যই খুব খুব দরকার। কেন জানো? সহজ উত্তর হলো- যোগাযোগ/যাতায়াতের প্রয়োজনে প্রায় সবারই কম-বেশি সড়ক ব্যবহার করা লাগে। রাস্তায় কখনো আমরা পথচারী (pedestrian) – হাঁটি, খাই বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই, কখনোবা যাত্রী (passenger), কিংবা চালক (driver)। আমরা সড়ক ব্যবহার করি তাই সচেতন হওয়া দরকার – স্রেফ এতটুকু যথেষ্ট না; বরং সাথে এটাও আমাদের বোঝা দরকার যে সচেতন না হলে কী ক্ষতি? আর সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত।
ক্ষতি বোঝার জন্য আসো কিছু অপ্রিয় বাস্তবতার সাথে পরিচিত হই:
- ২০২৩ সালে শুধু সড়কপথেই দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৯১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে ১১ হাজার ৪০৭ মানুষ। রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন-এর দেওয়া তথ্যমতে, এই প্রায় সাড়ে সাত হাজার মৃতদের ১৭ শতাংশই ১৮ বছর বা এর কম বয়সী[১]।
- দুর্ঘটনার ধরন (type of collision) ঘাটতে গিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দেখেছে, ২০২৩ সালের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫২.৮৩ শতাংশে পথচারীকে গাড়ি চাপা (collision between vehicle & pedestrian), ২০.৫ শতাংশে মুখোমুখি সংঘর্ষ (head-on collision), ১৪.২৯ শতাংশে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে (runoff the road) এবং বাকি ১২.২৮ শতাংশ বিবিধ[২]।
- সড়ক দুর্ঘটনায় একেকটা মৃত্যুতে আর্থিক ক্ষতির[1] পরিমাণ আনুমানিক ৭৫ লাখ টাকা।[৩]
এরকম হাজারো ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলা যাবে, কিন্তু আপাতত আর ওদিকে আগাচ্ছি না। এবার আসো নীচের প্রশ্নগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবি,
আচ্ছা বলো তো, অ্যারোপ্লেন দুর্ঘটনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে কত জন মারা গিয়েছে? আমাদের দেশ বাদ দাও, পুরো বিশ্বে কতজন? জানো? ১০২ জন।[৪] অথচ আমরা আকাশ ভ্রমণে যতটা না চিন্তিত/ভীত/প্রস্তুত থাকি, ততটা কি রাস্তাঘাটে চলার সময় থাকি?
মৃত্যু আল্লাহর বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত জায়গায়, নির্ধারিত অবস্থাতেই হবে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে মৃত্যুগুলোতে লুকিয়ে আছে আমাদের অবহেলা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মিশেলে জুলুম – তার হিসাব কি আখিরাতে আমাদের দেওয়া লাগবে না?
ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ–কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ [বুখারি, হাদীস নং- ২৫৯৬]
সামগ্রিক ক্ষতি নিয়ে উপরের কথাগুলো যদি মনে অল্প হলেও দাগ টেনে থাকে, তাহলে আসো এবার বোঝার চেষ্টা করি সচেতন সড়ক ব্যবহারকারী (road user) হিসেবে আমাদের মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত-
ছবিটা খেয়াল করো। এখানে যে ৫ টা অংশ দেখছো, সেগুলো আমাদের সড়কব্যবস্থার প্রাণ (fundamental elements of road traffic system)। ছবির বাম অংশ হলো আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট। প্রত্যেকটা অংশ বিচ্ছিন্ন এবং আমরা যেকোনো সড়ক দুর্ঘটনায় বা ভুল ব্যবস্থাপনায় একে অন্যের ভুল ধরে ‘বড় একটা কাজ করে ফেললাম’ ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। কেউ নিজের ঘাড়ে দোষ নিতে রাজি না, দায়িত্ব নিতে রাজি না। এটাই আমাদের ব্লেইম গেইম কালচার। এটা থেকে বের হয়ে এসে আমাদের প্রত্যেককে নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব নেওয়া শিখতে হবে।
ছবির ডান অংশে তাই দেখানো হয়েছে, যেখানে সড়কব্যবস্থার প্রত্যেকটা অংশ একে অপরের সাথে যুক্ত। এর মানে হলো, প্রত্যেকেই নিরাপদ সড়কব্যবস্থার জন্য দায়িত্বশীল। সড়ক ব্যবহারে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হওয়া, বিদ্যমান সমস্যায় ‘অন্যকে কুপোকাত করা’ মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে সম্মিলিতভাবে বসে কাজ করা এবং ‘সমস্যার মূলে’ নজর দেওয়া। একটা সহজ উদাহরণ দিই, ‘মহাসড়কে চালকের বেপরোয়া গতির কারণে মৃত্যু’ – এ ধরনের নিউজ আমরা প্রায়ই দেখি। এখানে ‘বেপরোয়া গতি’ সবসময় কিন্তু মূল সমস্যা (primary factor) না, অনেকক্ষেত্রে তা অন্য সমস্যার বহিঃপ্রকাশ (effect) যেমন – চালকের ক্লান্তি (fatigue) / তন্দ্রাভাব (drowsiness) / ক্রোধ (anger issue), যাত্রীর তাড়াহুড়ো, যানবাহনের ব্রেক ফেইল, মসৃণ রাস্তা (low skid resistance) ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো কেন হলো তা খতিয়ে দেখা, আমাদের রাস্তার অবকাঠামো ও চারপাশের পরিবেশকে এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে চালক/যাত্রী/পথচারীর ভুল হবার পরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ থাকে – এভাবে সামগ্রিকভাবে (holistic) চিন্তা এবং কাজ করাই হলো দায়িত্ব ভাগাভাগি। আমাকে, তোমাকে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা শিখতে হবে। এই হাদীসটা দেখো, রাস্তা থেকে কাঁটাযুক্ত ডাল সরানোতে আল্লাহ কত খুশি হয়েছিলেন যে, ব্যক্তিটি ক্ষমা পেয়ে গেল! তাহলে তুমি আমি যদি নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করি আল্লাহর জন্য, তাহলে কতই না প্রতিদান পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখন সে রাস্তার উপর একটি কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল দেখতে পেয়ে তা সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার এই ভালো কাজটি পছন্দ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ [মুসলিম, হাদীস নং- ৬৪৩১]
তথ্যসূত্র:
[১] 1,100 children killed on roads in 2023: Road Safety Foundation, Prothom Alo English, 27 Jan 2024, https://tinyurl.com/2023-accident
[২] ২০২৩ সালে সড়কে ৭,৯০২ জনের প্রাণহানি, যুগান্তর, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, https://tinyurl.com/jugantor-acc
[৩] ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতি ৫০ লক্ষ টাকা। মুদ্রাস্ফীতির জটিল হিসাবে না গিয়ে তা ১.৫ গুণ করা হয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিমাণটা বোঝাতে। বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি।
[৪] Aviation and Plane Crash Statistics, https://tinyurl.com/4fuy5v35
[1] সড়ক ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের জরিপে আর্থিক ক্ষতির হিসেব করতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল মানব-সম্পদ হারানোয় অর্থনৈতিক ক্ষতি, যানবাহনের ক্ষতি, চিকিৎসা খরচ, প্রশাসনিক খরচ ইত্যাদি। হিসাবে আনা হয়নি প্রাণ হারানো ব্যক্তির সামাজিক ক্ষতি, দুর্ঘটনাসৃষ্ট যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি, দেশের সামগ্রিক গড় আয়ুর উপর আর্থিক চাপ ইত্যাদি।
[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]