সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস: দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার (১ম পর্ব)

হাশরের ময়দানে অনেক[1] লোক আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন। সেই বিখ্যাত হাদীসটিতে সাত শ্রেণির লোকের কথা নির্দিষ্ট করে বলা আছে।[2] কিন্তু এছাড়াও আরও কিছু লোক আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন এমন একটা দিনে, যেই দিনটা হবে পঞ্চাশ হাজার দীর্ঘ। সূর্য থাকবে মাথার খুব কাছে। মানুষজন তাদের ঘামে হাবুডুবু খাবে। এবং আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। সেই ভয়াবহ দিনে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন এমন কতগুলো মানুষ, যারা তাঁদের যৌবন  আল্লাহর ইবাদাতের মাধ্যমে কাটিয়েছেন।

মানুষের যৌবন আল্লাহ’র এক বড় নিয়ামত। অথচ দেখো, বর্তমান সমাজে এই আমরা সবচেয়ে বেশি পাপাচারে লিপ্ত। নারী আর মাদকের ভয়াবহ ফিতনায় নিমজ্জিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হাশরের ময়দানে মানুষ তার যৌবন কী কাজে ব্যয় করেছে তার কড়ায় গন্ডায় হিসাব নেবেন। এবং এর হিসাব দেওয়া ছাড়া আমরা এক কদমও আগাতে পারব না। মানুষের যৌবন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ!

আমাদের আজকের হিরো তাঁর পুরো জীবন বিশেষ করে তাঁর যৌবন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেছেন। আমাদের আজকের হিরো কোনো কোনো বর্ণনামতে রাসূলুল্লাহ ﷺ  এর পরিবারের বাইরে ইসলাম গ্রহণ করা চতুর্থ ব্যক্তি, আবার কোনো কোনো বর্ণনা মোতাবেক তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি সেই দশজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির মধ্যে একজন, যাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি ‘ফারিসুল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের ঘোড়সওয়ার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লোকেরা তাঁকে সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস নামেই চিনত।

তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখনো তাঁর জীবনের ২০টি বসন্ত পার হয়নি। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সাদ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমি অন্ধকারে ছিলাম। এমন সময় আকাশে একটা চাঁদ উঠে সবকিছু আলোকিত করে দিল। আমি চাঁদটাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে আবু বকর, আলী এবং যায়িদ বিন হারিসাকেও সেই চাঁদটা অনুসরণ করতে দেখলাম।’

এই স্বপ্নের কিছুদিন পরেই সাদ, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মায়ের খুবই অনুগত ছিলেন। মা-বাবার অবাধ্য মক্কার দুষ্টু ছেলেদেরকে প্রায়ই শুনতে হতো, ‘দেখ, সাদকে দেখ! সে তার মায়ের কত অনুগত! হতচ্ছাড়া তোরা সাদের মতো হতে পারিস না!’

ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসার পর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর পরিবারের বিশেষ করে তাঁর মায়ের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। মা তাঁর নিকট এসে বললেন, ‘সাদ! তুমি যদি মুহাম্মাদের ধর্ম ত্যাগ না করো, তাহলে আমি খাবার, পানি কিছুই স্পর্শ করব না এবং মক্কার গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকব। এভাবে আমি যখন মারা যাব তখন মক্কার লোকজন তোমাকে দেখিয়ে বলবে এই পিশাচটা তার নিজের মাকে খুন করেছে।’

একদিন চলে গেল। সাদের মা কোনো কিছুই খেলেন না। দুই দিন চলে গেল সাদের মা এদিনও কিছুই খেলেন না। তার শরীর প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। তৃতীয় দিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মাকে যেয়ে বললেন, ‘ইয়া উম্মি! আপনার যদি ১০০টা প্রাণ থাকে আর আপনি যদি এভাবে আপনার ১০০টা প্রাণকেও হত্যা করেন, তাহলেও আমি আমার ইসলাম ত্যাগ করব না। ছেলের এমন পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা দেখে তাঁর মা অনশন ভঙ্গ করেন।’

পরবর্তীতে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মা ইসলাম কবুল করেন। এই কাহিনি আরেক দিন বলব ইনশাআল্লাহ।

রহমান আল্লাহ সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর দৃঢ়তাকে সম্মান জানানোর জন্য কুরআনে আয়াত নাযিল করলেন, যেটি কিয়ামাত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে।

‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে; কিন্তু তারা যদি তোমার উপর বলপ্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরিক করতে, যে সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদেরকে মান্য কোরো না। আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দিব যা তোমরা করতে।’ (সূরা আল আনকাবুত, ২৯:৮)

আরে এত অল্প বয়সে কেউ দাড়ি রাখে নাকি, দাড়ি কেটে ফেল, দাড়ি রাখলে তোকে জঙ্গি বলবে, এখন পর্দা করিস না, বোরখা-নিকাব পরার দরকার নেই, বয়স হলে, বিয়েশাদি হলে করিস, রোযা সব রাখার দরকার নেই, রোযা রাখলে তো পড়তে পারবি না, পরীক্ষা খারাপ হবে… এমন অনেক কথাই হয়তো আমাদের বাবা-মা আমাদের বলেন। এগুলো স্পষ্টতই আল্লাহ যেমন বলেছেন তার বিপরীত কথা, তাই না? আমরা বাবা-মায়ের এসব আদেশ মানব না। তাদের কথা শুনব না। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আমাদের আচরণে যেন বেয়াদবি প্রকাশ না পায়। খারাপ ব্যবহার করব না, বেয়াদবি করব না; কিন্তু তাদের এসব কথা মানবও না।

(চলবে ইনশাআল্লাহ…)


[1] শেইখ জহির মাহমুদের লেকচার অবলম্বনে।

[2] বুখারি, হাদীস নং: ১৭৪; মুসলিম, হাদীস নং : ১৭১২

[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]


by

Tags: