১, ২, ৩ একটু সর্পকথন

এই বেশ কয়েকদিন আগে, টেলিগ্রামে একটা ভিডিও দেখে রীতিমত চমকে উঠলাম। পদ্মা নদীর পাড়ে একটা প্রাণী দ্রুত চলে যাচ্ছে, যেন কাউকে ধাওয়া করছে। বুঝতেই পারছো কীসের কথা বলছি? হ্যাঁ, দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়া রাসেল’স ভাইপার (নামটা কিন্তু “রাসেল ভাইপার” নয়)। সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত আতঙ্ক, যখন তখন চলে আসবে না তো? ক্লাসমেটদের মধ্যে অনেকে ওয়াশরুমে যেতেও ভয় পাচ্ছিল, যদি ওয়াশরুমের পাইপ দিয়ে উঠে আসে! আচ্ছা, এ ব্যাপারে বেশি কিছু বলার আগে দু-একটা অদ্ভুত ঘটনা বলে নিই।

ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি প্রদেশ। সময়কাল ২০১৮। সবুজ পাহাড় আর নীল লেকের ছবির মতো একটি দ্বীপ মুনা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ওই দ্বীপের বাসিন্দা থিবা তার বাগানে গিয়েছিলেন শাক-সবজির পরিচর্যা করতে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। থিবা কি জানতেন এই দিনটি তার জীবনের আর দশটি সাধারণ দিনের মতো হবে না?

থিবা নিখোঁজ হয়ে গেলেন। আশেপাশের সাধারণ মানুষেরা তাকে খুঁজতে লাগল। পুরো একদিন খুঁজেও থিবাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বাগানে থিবার স্যান্ডেল আর ছুরি খুঁজে পায় সবাই। হঠাৎ একজন খেয়াল করল, যেখানে স্যান্ডেল পাওয়া গিয়েছিল তার প্রায় ৩০ মিটার দূরে, একটা পেট বিশ্রীভাবে ফোলা পাইথন মানে অজগর সাপ বসে আছে!

সবার সাপটার প্রতি সন্দেহ হয়। সন্দেহবশত সাপটাকে এলাকাবাসী মেরে ফেলে। এরপর পেট কেটে দেখে, এ কী কাণ্ড! আস্ত থিবার শরীর পাইথনটার পেটে! পা-বিহীন এই সরীসৃপটা থিবাকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছিল, থিবার শরীর পর্যন্ত দুমড়ে মুচড়ে যেতে পারেনি। পুরো একদিন থিবা মৃত অবস্থায় পাইথনটার পেটে ছিলেন। ৫৪ বছর বয়সেই নির্মম মৃত্যু ঘটল থিবার।

পাইথনটি ছিল ২৩ ফুট লম্বা। তবে মানুষখেকো এমন সাপের ঘটনা এটাই কেবল নয়। একদম সাম্প্রতিক এই বছরের জুন মাসে একই দ্বীপের ৪৫ বছর বয়সী ফরিদাকে পাইথন গিলে ফেলে। সাপটির পেটে ফরিদার দেহ পাওয়া যায় তার পোশাকসহ! ইন্দোনেশিয়ার জামবি প্রদেশে ২০২২ সালে একজন নারীকে ১৬ ফুট লম্বা একটি পাইথন গিলে ফেলে। তার মরদেহও সাপের পেটে পাওয়া যায়। ২০২২ সালের মার্চ মাসেও একজন ২৫ বছর বয়সী তরুণ কৃষককে আরেকটি পাইথন গিলে ফেলেছিল। ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি রক পাইথন ১০ বছর বয়সী বাচ্চাকে খেয়ে ফেলেছিল। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে একটি পাইথন ৫ বছর বয়সী বাচ্চাকে পেঁচিয়ে ধরে সুইমিং পুলে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে বাচ্চাটা বেঁচে যায়।

এভাবে সাপের আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলার ঘটনা যদিও বিরল, তবে সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। বিবিসি সাইন্স ফোকাস জার্নালের হিসেব অনুযায়ী, বিপজ্জনক প্রাণীর তালিকায় সাপ আছে তিন নম্বরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষকে সাপ দংশন করে এবং এর মধ্যে প্রায় ৮১ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যারা বেঁচে যান তারাও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন অঙ্গহানি, পঙ্গুত্ববরণ করেন। অনেকের মানসিক সমস্যাও দেখা যায়।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর হিসেব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়, যার মধ্যে প্রায় ৭ হাজার মানুষ মারা যায়। এদের মধ্যে কেউটে এবং কোবরা সাপ ছিল প্রধান।

ফিরে আসি আমরা যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কী? ভয় লাগছে? রাসেল’স ভাইপার আবার খেয়ে ফেলবে না তো?

না, না। হা হা হা।

রাসেল’স ভাইপার আসলে আমাদের দেশেরই একটি সাপ; চন্দ্রবোড়া সাপ। চট্টগ্রাম মেডিকেল সেন্টারের হিসেবে, দেশের উত্তরাঞ্চল ছাড়াও ২৭টি জেলায় এই সাপটি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে যতটা আতঙ্ক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে ততটাও ভয়ঙ্কর সাপ এটি নয়। এটি কেউটে বা কোবরার চেয়ে কম প্রাণঘাতী। বাংলাদেশ টক্সিকোলোজি সোসাইটির সভাপতি মোঃ আবুল ফয়েজ বলেন, ‘চন্দ্রবোড়া সাপ বা রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে মানুষের মৃত্যু ঘটতে। সর্বোচ্চ ২৫ দিন পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকার রেকর্ডও আছে।’

সাপের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেসব এলাকায় সাপ আছে তার আশেপাশে না যাওয়া (এসব ক্ষেত্রে সাহসিকতা না দেখানো; মনে রাখতে হবে জীবন কোনো সিনেমা নয়)। সাপ কামড় দিলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত এন্টিভেনোম প্রয়োগ করা, কোথাও সাপ দেখা দিলে স্থানীয় লোকজনকে জানানো এবং ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।

রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের ক্ষতিকর প্রাণী থেকে বেঁচে থাকার দুআ শিখিয়েছেন।

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

উচ্চারণ: আ’ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মা-তি, মিন শাররি মা-খালাক্ব

অনুবাদ: আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয় গ্রহণ করছি; তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার অকল্যাণ থেকে।

হাদীসে এসেছে, আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, গত রাতে আমাকে একটি বিষাক্ত বিচ্ছু কামড় দিয়েছিল। তাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। তিনি বলেন, “যদি তুমি সন্ধ্যার সময় এ কথা (উপরোক্ত দুআটি) বলতে তাহলে তা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারত না।” অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন: “যদি কেউ সন্ধ্যায় তিন বার এ বাক্যটি বলে সে রাতে কোনো বিষ বা দংশন তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।”

সকাল-সন্ধ্যায় দুআটি পড়তে ভুলে যেয়ো না কিন্তু!

[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]

রেফারেন্স:

১. বিবিসি নিউজ, ১৮ জুন, ২০১৮ – https://www.bbc.com/news/world-asia-63396954

২. ইউএসএ টুডে, ১০ জুন ২০২৪ – https://tinyurl.com/yj37t624

৩. বিবিসি নিউজ, ২৬ অক্টোবর ২০২২ – https://www.bbc.com/news/world-asia-63396954

৪. বিবিসি নিউজ, ১৮ জুন, ২০১৮ – https://www.bbc.com/news/world-asia-63396954

৫. প্রাগুক্ত।

৬. দ্যা স্ট্যান্ডার্ড (ইউকে), ২৫ নভেম্বর ২০২২ – https://tinyurl.com/aprvymvz

৭. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২৭০৯


by

Tags:

Comments

Leave a Reply