২০২০ এর ঘটনা। করোনকালীন সময়ে যখন ঘরে বসে থাকতে থাকতে জীবন প্রায় দুর্বিষহ হয়ে পড়ার উপক্রম, তখন ঠিক করলাম ক’দিনের জন্য খালামণির বাসা থেকে ঘুরে আসি। খালাতো ভাইয়ের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। বাসা দূরে কোথাও নয়, ঢাকার ভেতরেই উত্তরা এয়ারপোর্ট এরিয়াতে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় পৌঁছানোর পর আমাকে দেখেই খালামণি খুশিতে আত্মহারা। সারপ্রাইজ দেব বলে জানিয়ে আসিনি। আর আতিথেয়তা, আপ্যায়নের ক্ষেত্রে খালামণির জুড়ি নেই!
প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট হয়ে গেল এসেছি, কিন্তু এখনো খালাতো ভাই রাকিবকেই দেখছি না। রাকিব এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। আমার চেয়ে বয়সে ৪-৫ বছরে জুনিয়র হলেও প্রাণ খুলে আড্ডা দেওয়ার মানুষ হিসেবে রাকিবের জুড়ি নেই। খালামণিকে জিজ্ঞেস করলাম, রাকিব কোথায়? দেখছি না যে?
খালামণি চায়ের কাপটা রাখতে রাখতে বলল, ওর কথা আর বলিস না, এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি।
চোখ দুটো অজান্তেই দেয়াল ঘড়ির দিকে চলে গেল, বারোটা বিশ বাজে।
খালামণি বলল, এটা তো তার এখন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছে। যা, রুমে গিয়ে দেখ তোর ভাইকে উঠাতে পারিস কি না।
চা-টা শেষ করে রাকিবের রুমের দিকে গেলাম। দরজাটা অর্ধেক চাপানো। খাটের পাশে বসে তাকে ডাকা শুরু করলাম। আমার ডাক শুনে এক চোখ খুলে উঁকি মেরে আমার দিকে তাকাল। চোখটা আবার বন্ধ করে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অস্ফুট গলায় বলতে লাগল, আরে ভাইয়া… তুমি এসেছ, খুব ভালো হয়েছে। আমি একটু ভারী গলায় বললাম, ‘ক’টা বাজে, জানিস? এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার কারণ কী শুনি’?
রাকিব ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বলল, ‘কাল রাত দশটা থেকে টানা তিনটা মুভি দেখেছি। ঘুমালামই তো কেবল সাড়ে ছ’টার দিকে’।
সাড়ে ছটা তোর কাছে ‘কেবল’ মনে হচ্ছে? এখন উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়, যা।
রাকিব হাসতে হাসতে উঠে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে, তখন বললাম, ‘ফজরের সালাত যদি না-পড়ে থাকিস, তাহলে একসঙ্গে ওযু করে বের হবি। রাকিব হাসিমুখে ‘ওকে ভাই’ বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল’।
এই করোনাকালীন সময়গুলোকে অফুরন্ত মনে করে অধিকাংশ কিশোর এবং যুবকেরা খেয়াল খুশিমতো সময়কে পার করছে। রাকিবও তার ব্যতিক্রম নয়। এ যে শুধু সময়ের অপচয় তা কিন্তু নয়, বরং চতুর্মুখী ক্ষতি। রাকিব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। হাত মুছতে মুছতে জায়নামাজটা নিয়ে ফজরের কাযা করা সালাত আদায় করছে। রাকিবের মধ্যে একটা ভালো দিক রয়েছে, যখনই তাকে কোনো বিষয়ে সচেতন করি, নির্দ্বিধায় তা গ্রহণ করে। ইনিয়ে বিনিয়ে ভুলের ওপর থাকতে চায় না।
রকিব সালাত আদায় করে আমার পাশে বসল। জিজ্ঞেস করলাম—আচ্ছা, তোর কি কখনো এমনটা হয়েছে যে, তুই রাতে ঘুমাতে চাচ্ছিস কিন্তু কোনোভাবেই ঘুম আসছে না? আমি যেন রাকিবের মনের কথাটাই বলে দিলাম—চোখেমুখে এমন একটা কৌতুহল নিয়ে সে বলল, ‘হ্যাঁ ভাই। আমার তো ইদানীং প্রতি রাতেই এমনটা হয়। আগে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম আসে না, তাই মুভি দেখি। আর দিনের অধিকাংশ সময় চলে যায় ঘুমিয়ে।’
আমি বললাম, ‘তোরও তাহলে অনেক যুবক এবং কিশোরদের মতো ‘স্লিপ সাইকেল’ পিছিয়ে গেছে।’
রাকিব বলল, ‘স্লিপ সাইকেল মানে ঘুম চক্র?’
-আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, ঘুম চক্র।’
-তাহলে স্লিপ সাইকেল আবার পিছিয়ে যায় কীভাবে?
-গুড কোশ্চেন। দেহঘড়ির নাম শুনেছিস?
-হ্যাঁ ভাই, ছোটবেলা থেকে বহুবার শুনেছি।
-একেই মেডিকেল টার্মে বলে ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ মানে জৈব ঘড়ি বা দেহ ঘড়ি। একজন মানুষ নিয়মিত কয়েকদিন যদি একটি সময়ে ঘুমায় এবং ঘুম থেকে উঠে আমাদের শরীর নিজে থেকেই ওই সময়কে ঘুমের সময় হিসেবে চিনে নেয়। আর যখন একবার ঐ সময়টি ঘুমের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়, তখন ঘুমের সময় আসলেই শরীরে ঘুমধুম পাওয়া শুরু করে আর এলার্ম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যায়।
রাকিবকে দেখে মনে হচ্ছে আমার এই আলোচনা রাকিবের বেশ ভালো লাগছে। রাকিব খাটের উপর পা উঠিয়ে নড়েচড়ে বসল।
আমি কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম, তো বায়োলজিক্যাল ক্লক অনুযায়ী ঘুমানো এবং ঘুম থেকে উঠার এই চক্রকেই বলে ‘স্লিপ সাইকেল’।
রাকিব বলল, ‘বুঝতে পারলাম। কিন্তু এর সাথে ‘স্লিপ সাইকেল’ পেছানোর সম্পর্কটা কী?’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘মানুষের জন্য আদর্শ ঘুমের সময় হচ্ছে রাত ন’টা থেকে দশটা। কিন্তু ধর একজন লোক কোনো কারণে নিজে থেকে ইচ্ছে করে সেই সময়ে না ঘুমিয়ে পাঁচ-ছ’ দিন টানা অন্য একটি সময় ঘুমায় আর অন্য সময় জাগে, তখন শরীর তার সেই অনিয়মিত সময়টিকেই ঘুমের সময় ভেবে নেয়। এক্ষেত্রে মূলত লোকটি নিজেই তার শরীরকে এমনটি ভাবতে বাধ্য করিয়েছে।
এই যে লোকটির নিয়মিত বা আদর্শ ঘুমের সময় থেকে তার বায়োলজিক্যাল ঘড়ির সময় সরে গেল, একেই বলা হয় স্লিপ সাইকেল পিছিয়ে যাওয়া অথবা ডিলেইড স্লিপ সাইকেল ডিজঅর্ডার।’
রাকিব অনেকটা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এটা কি কোনো রোগ?’
আমি বললাম, ‘অনেকটা রোগই বলতে পারিস, তবে ভয়ের কিছু নেই। এটি অভ্যাসের সাথে সম্পর্কিত। এটি হওয়ার পেছনে মূল কারণ কী, জানিস?’
রাকিব হতবাক ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল।
আমি বললাম, ‘এর মূল কারণ হচ্ছে স্মার্টফোন এবং ল্যাপটপ থেকে বের হওয়া ব্লু-রে blue-ray বা নীল রশ্মি।
কেউ যখন দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন এই ব্লু-রে অনেক বেশি সময় ধরে তার চোখে প্রবেশের সুযোগ পায়। আর এর ফলশ্রুতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি যা হয় তা হচ্ছে এই ‘স্লিপ সাইকেল চেইঞ্জ ডিজঅর্ডার’।’
রাকিব বলল, ‘আমার ক্ষেত্রে তো তাই হয়েছে মনে হচ্ছে, এই করোনাকালীন সময় যেই পরিমাণ মুভি দেখেছি। একটানা দুই থেকে তিন ঘণ্টা স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একেকটি মুভি চলাকালীন।’
আমি বললাম, ‘হুম। আর সেই সাথে চোখের দৃষ্টি শক্তির ওপর মারাত্মক ক্ষতির প্রভাব আছেই। কারও যদি ঘুমের সময় এভাবে সরে গিয়ে দিনের বেলা চলে যায়, তাহলে তো তার জীবনে ভোগান্তি আরও বেশি। কারণ, পুরো রাত বেচারা না-ঘুমিয়ে কাটায়, আর দিনের বেলা কাজের সময় ঘুমিয়ে পার করে দেয়। পড়াশোনা বা কোনো কাজে মন বসাতে পারে না। মাথা ঝিম ঝিম করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। বয়স ত্রিশের কোঠা পার হলেই শরীর ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। এরচেয়ে করুণ অবস্থা আর কী হতে পারে!’
রাকিব ভাবুক চেহারা নিয়ে তার মোবাইলটি হাতে নিয়ে বলল, ‘ভাই, তাহলে তো আমার স্লিপ সাইকেলকে আগের জায়গায় আনার জন্য এই মুভি দেখার বদভ্যাস যেকোনোভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে আমাকে।’
‘দ্যাটস মাই ব্রাদার, প্রাউড অফ ইউ’—আমি আনন্দিত হয়ে বললাম।
রাকিব মুচকি হাসি দিল।
ইতোমধ্যেই ঘরের ভেতর জানালা দিয়ে আসা যুহরের আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমি সালাতের জন্য উঠে দাঁড়ালাম। রাকিবও আমার সাথে উঠে পড়ল। বলল, ‘চলেন ভাই, আজকে একসাথে সালাতে যাব।’