ঘুমের ভেতর-বাহির

ঘুম আমাদের জন্য খুব জরুরি একটা জিনিস। কিন্তু ঘুম নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ মনে করেন দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা ঘুমানো যথেষ্ট, আবার কারও কারও দৈনিক ৯-১০ ঘণ্টা না ঘুমালে চলেই না। কিন্তু না ঘুমুলে কী হবে? ঘুমের ভেতরে আসলে কী কী ঘটে?

অনেক আগে মানুষ মনে করত, ঘুমুলে মানুষের আর কোনো জ্ঞান থাকে না। তার মস্তিষ্কের সকল ক্রিয়াকৌশলও বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু না! আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ঘুম সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য আবিষ্কার করেছে। ১৯৩১ সালে হ্যান্স বার্জার নামে এক মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন বয়সী ঘুমন্ত মানুষের মাথায় ইলেক্ট্রড লাগিয়ে মাথার ভেতরের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো মাপার চেষ্টা করে। তার এই গবেষণায় দেখা যায়, ঘুমন্ত মানুষের মস্তিষ্কেও অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলে। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের দিকে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখল, ঘুমের বিভিন্ন স্তর রয়েছে৷ ঘুম ৯০-১১০ মিনিটের একটি  চক্রে আবর্তিত হয় এবং একে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে : Non-REM (Non-Rapid Eye Movement- নন র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুম এবং REM (Rapid Eye Movement- র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুম। Non-Rem  ঘুমের আবার চারটি ধাপ রয়েছে।

প্রথম ধাপটি হলো একেবারে প্রাথমিক স্তর। এই ধাপে আমরা থাকি আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে। ঘুম থাকে খুব হালকা এবং সহজেই আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। দশ মিনিট প্রথম স্তরে অবস্থানের পর পরবর্তী দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই দ্বিতীয় ধাপে। এ ধাপে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রকৃতি এবং হৃৎপিণ্ডের গতি কম হয়ে আসে। এই ধাপটি ঘুমের সবচেয়ে বৃহত্তম অংশকে নির্দেশ করে। তৃতীয় ধাপে মস্তিষ্ক থেকে ডেলটা তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎপিণ্ডের গতি সবচেয়ে নিচে নেমে আসে। চতুর্থ ধাপে শ্বাস-প্রশ্বাসে থাকে ছান্দিক গতি, পেশীসমূহের কার্যকলাপ থাকে সীমিত। তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে আমরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকি। কোনো কারণে এই সময়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমরা সহসাই পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারি না এবং এই অস্থিরতা বেশ কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়। আমাদের অনেকের সাথেই এমন ঘটে। অনেক সময় আমরা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারি না, এখন সকাল না কি বিকাল। মূলত এই স্তরে ঘুম থেকে হঠাৎ  জেগে উঠলেই এমনটা হয়। এভাবে চল্লিশ মিনিট গভীর ঘুমের পরে মানুষ আবার আগের স্তরে ফিরে যেতে থাকে; চতুর্থ থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে দ্বিতীয়। কিন্তু মজার বিষয় দ্বিতীয় স্তর থেকে ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি স্তুরে না গিয়ে চলে যায় REM-এ। এটি ঘুমের সবচেয়ে মজার স্তর।  এ অবস্থায় যদি কাউকে ডেকে তোলা হয়, তাহলে প্রায় সবাই মনে করেন তারা কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিল। মূলত এই স্তরের মধ্যদিয়ে যাওয়ার সময়ই মানুষ রাতের প্রথম স্বপ্নটি দেখে। এক থেকে দশ মিনিট এই স্তরে থাকার পর আবার আগের মতো দ্বিতীয় তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তর বা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরে৷ প্রতি ৯০-১২০ মিনিট পর পর মানুষ এই পুরো চক্রটির ভেতর দিয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে প্রথম REM এর তুলনায় দ্বিতীয় REM এর স্থায়িত্ব আরও বেশি হয়৷ আবার দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ বড় হয়। এভাবে বাড়তে থাকে।[1]

এই REM বা রেপিড আই মুভমেন্ট আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সারাদিনের স্মৃতি পাকাপোক্তভাবে সাজিয়ে রাখা এবং নতুন নতুন নিউরনের মাঝে সংযোগ স্থাপনের জন্য এটি সাহায্য করে।

সবই তো বুঝলাম, কিন্তু অনেকে একটা প্রশ্ন করে থাকে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কত ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন?

আসলে এই প্রশ্নের কোনো নির্ধারিত উত্তর নেই৷ প্রত্যেকের ঘুমের চাহিদা ভিন্ন। তোমার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ঘুমানো উচিত। তবে বেশি ঘুমানো যেমন ক্ষতিকর, কম ঘুমানোও ক্ষতিকর৷ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় এক লক্ষ গাড়ি এক্সিডেন্ট হয় এই ঘুমের কারণে এবং তাতে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়৷[2] এ ছাড়াও অবাক করা বিষয়, পৃথিবীর ইতিহাসের দুইটি ভয়ংকর নিউক্লিয়ার বিষ্ফোরণ হয়েছিল ঘুমের কারণেই। ভোররাতে চেরনোবিল এবং থ্রি মাইল আয়ারল্যান্ড নিউক্লিয়ার প্লান্টের কর্মকর্তারা যখন ঘুমের কারণে বিপদ সংকেত উপেক্ষা ক,রে তখনই হয়ে যায় এই ভয়ংকর দুর্ঘটনা![3]

অনেকের মধ্যে রাত জেগে পড়ার অভ্যাস আছে; বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু এটা মোটেও স্বাস্থ্যকর কোনো কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সার বিষয়ক গবেষণা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্যমতে, যখন সূর্যের আলো থাকে না, তখন শরীরকে কাজ করতে বাধ্য করা বা জাগিয়ে রাখা শরীরে মেলাটনিন হরমোন তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে। আর এই মেলাটনিনই মানুষের দেহে টিউমারের বৃদ্ধিকে রোধ করে। ফলে তাদের ধারণা, রাত জাগা মানুষদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।[4] অর্থাৎ রাতের ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি কোনোভাবেই দিনের বেলায় ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায় না।

‘তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ করো ও তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ [5]


[1]  Sciencedaily, Ektukhani biggan

[2] Sleepfoundation.org

[3] Wikipedia (En)

[4] WHO

[5] সুরা কাসাস, ২৮ : ৭৩।


by

Tags: