বার্গার

“রুটির মধ্যে কী দিছোছ?”

“সস।”

“খালি সস? আর কিছু মিশাছ নাই? অজ্ঞান করার কিছু?”

জারিফ একটু হাসলো। তার চোখ দু’টো শান্ত। জগতের সমস্ত মায়া যেন নেমে এসেছে ওখানে। তার পেলব হাতে হাতকড়া মানাচ্ছেই না। কেনই বা মানাবে? হাতকড়ায় তো অভ্যস্থ নয় হাতগুলো। এই হাতে আছে জাদু, তৈরি হয় সুস্বাদু বার্গার। অনেক মানুষ খেয়েছে তা, গুনতে গেলে হাজার হয়ে যাবে।

“বার্বিকিউ সস।”

“রঙ্গ করোছ? তামাশা, হ্যাঁ? ঠিকমতো কথা বল!”

পুলিশের ধমকে জারিফ নড়েচড়ে বসল। ঠিক পর মুহূর্তেই তার চেহারায় ফিরে এলো পুরোনো সাদাটে ভাব, নিশ্চিন্ত, কোমল রূপ- যেন গায়েই লাগছে না সে থানায় আছে।

“প্রথমে চুলায় শিকে বসাই মুরগির মাংস, ম্যারিনেট করে আনি বাসা থেকে। কয়লায় আগুন দিই, আগুনের উত্তাপে শিক গরম হয়। এরপর বার্গারের বানের মধ্যে ধনেপাতার সস আর মেয়োনেজ দিই, সাথে শসা। এর মধ্যে হয়ে আসা শিক কাবাব দিই, অল্প একটু টমেটো সস আর বার্বিকিউ সস। শেষ।”

“বেয়াদ্দপ!”

জারিফকে কষে থাপ্পর দিলেন পুলিশ। বয়স বিয়াল্লিশের মতো, বুকের পাশে লেখা “বাহার”। সার্জেন্ট।

“সবসময় মনে রাখবেন স্যার, মানুষ যখন বার্গার মুখে দেয়, সসগুলো আলাদা করার উপায় থাকে না। কথাটা মনে রাখবেন। অবশ্যই মনে রাখবেন।”

এক টানে ধরাম করে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। একা, একটা ছোট আয়তনের কক্ষে কেবল একটা লাইট ঝুলছে, ব্যাপারটা দেখতে জারিফের ভালোই লাগে।

ইনবক্সে টুং করে উঠল মেসেজ।

“হাতিরঝিলে আয়। আড্ডা দিই।”

আসরের পর সাধারণত আমি বের হই না। মাগরিব হয়ে যাবে, নিতান্ত অল্প সময়। আড্ডা একবার শুরু হলে শেষ হবে না জানি, তবু আদিবের জন্য বের হচ্ছি। সামনের মাসে চলে যাচ্ছে বাইরে, আর দেখা হবে কিনা জানি না। আরাফাত আসবে, ওর অবস্থাও বেশ ভালো। অল্প কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে, একা রয়ে গেলাম আমিই। তা নিয়ে অবশ্য আফসোস নেই, আল্লাহর ইচ্ছা। যা হবে ভালোর জন্যই হবে।

কৃত্রিম ঝিলের পানি সবসময়ই শান্ত, স্টিমার চলে এপাড় থেকে ওপাড়ে সোজা গুলশান-১। বিকালের দিকে এখানে ভিড় থাকত বটে, আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। কেউ কিছু বলছে না দেখে আমিই শুরু করলাম,

“কীরে আদিব? ফ্লাইট কবে?”

কেউই কোনো উত্তর দিলো না।

“ক্যান্সেল হয়ে গেল নাকি?”

“আচ্ছা রিফাত, জারিফ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না কেন?”

আদিবের কথায় আমার মনে পড়ে গেল, এখন থেকে চার-পাঁচ বছর আগে, যখন আমরা কলেজে পড়তাম, এখানে এসে দাঁড়াতাম চারজন। এরপর চলে গেলাম ভিন্ন ভিন্ন শহরে, পড়াশোনার চাপ আর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবার ক্লান্তিতে একত্রে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়নি। আজ এত বছর পর একত্রিত হয়েছি, ব্যাপারটা টেরই পাইনি!

“করে তো, অনলাইনে পোস্ট তো দিতই। ইদানীং কম দেয় বা দেয় না।”

“দ্যাখ আরাফাত…”

আদিব ফিরল আমাদের দিকে, “ব্যাপারটা সুন্দর যে আমিও বুঝতে পারিনি কতদিন পর কথা বলছি একসাথে তোদের সাথে, কিন্তু ব্যাপারটা একইসাথে ভয়ানক কষ্টের যে জারিফ এলো না। আমি চলে যাচ্ছি, তুই থাকবি দূরে, রিফাত হয়তো ঢাকাতেই থাকবি, আমাদের আবার কি দেখা হবে? আর এর চেয়েও বড় কথা…”

“হয়তো সময় মিলেনি…”

“থাম, থাম,” আমাকে থামিয়ে দিয়ে আদিব বলল, “আমাকে গতকাল ফোন করেছিল।”

“কে? জারিফ!”

আমি আর আরাফাত একত্রে বলে উঠলাম। ফোন করা খুব সাধারণ ব্যাপার হতো, যদি না ব্ল্যাকআউট থাকত সারাদেশে। অনলাইনে যোগাযোগ বলতে এতদিন ছিল ভিপিএন, এখন ফোনের মেসেজ অথবা সাধারণ কল। যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যম নেই।

“হ্যাঁ, ও-ই।”

“কী বলল?” আমি গাধার মতো বললাম।

“আগামীকাল দুপুর ৩টা। রামপুরা বাস স্ট্যান্ডে দেখা করতে চায়। সবাই আসবি।”

জোবায়েদা আক্তারের দিনলিপি

ভোরবেলাই উঠে গিয়েছিলাম আজকে। উহু, তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই যদিও। এই নেট-ফেট নেই, তাই ফেবুতে স্ট্যাটাস না দিয়ে কষ্ট করে লিখতে হচ্ছে, হু। নইলে এতক্ষণে একটা স্ট্যাটাস দিয়েই দিতাম। তো আজকে খুব সুন্দর একটা দিন গেল, ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন কী হয়, এরপরেও খুব ভালো কেটেছে। দেশে অরাজক ছাত্রদের শায়েস্তা করতে শুরু করেছে পুলিশ। আজ সারাদিন বাসার উপর হেলিকপ্টার ঘুরছিল, এত ভয় লাগছিল! ছবি তুলে রেখেছি আমি! বনবন করে ঘুরছিল কপ্টারটা! পরে বুঝলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দুষ্কৃতিকারী ছাত্রদের জন্যই আনা হয়েছিল দু-দুটো কপ্টার। যে গুলি চলেছে বাবা! আর ওদের যা ঢং! ব্র্যাকের নাকি নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার, নিজস্ব অক্সিজেন সাপ্লাই আছে। তো কই এখন? সব শেষ হয়ে গেল? হবেই তো! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশদ্রোহী পালতো, এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সন্ত্রাসীদের আখড়া হয়ে গেছে! রক্তের ব্যাগ নাকি ফুরিয়ে গেছে, অক্সিজেন নেই, আহত সন্ত্রাসীরা এরপরেও থেমে নেই। বুকের পাটা দেখার মতো! দেশের খেয়ে, দেশের পরে এখন একেকজন দেশের ভালো চায় না! আল্লাহ বিচার করবে এদের!

কপ্টারটা দেখার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম, উঃ আল্লাহ! কী গুলি! পাখার শব্দেই বুক কেঁপে যায় আমার, সেখানে গুলি! ব্র্যাকের ছাদ দেখা যায় বারান্দা থেকে, সন্ত্রাসীদের পালানোর উপায় নেই। কিন্তু গুলি? সে তো এলোপাতাড়ি গুলি! ঠাস করে একটা বুলেট এসে লাগল পাশের বাসার বারান্দায়! ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠেছিল আমার। চেয়ারের নিচে লুকিয়ে পড়ি, ফুলের টব পড়ে মাথায় আমার। শোঁ শোঁ শোঁ ! নিশ্চুপ কলোনিতে একটা চিৎকার ভেসে এলো কোথা থেকে। কণ্ঠটা ছোট কোনো বাচ্চার হবে। কী হলো!

একটা মেয়ে বাচ্চা। ৭-৮ বছর হবে। বারান্দায় ঝুলছিল দেহটা, চোখগুলো খোলা, হাতগুলো গ্রিলে ধরা। পাঁজরের নিচ বরাবর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে, গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে বুক থেকে। উঃ কী দৃশ্য! আমার বমি এসে গেল!

সারাদিন গুলিবর্ষণের শব্দ আকাশ থেকে। ইস্ট-ওয়েস্ট আর ব্র্যাক থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আমি আপাতত মাথায় বরফ দিচ্ছি। বুঝি না সন্ত্রাসীরা কী চায়? ওদের জন্যই আজকে ছোট বাচ্চাটার জীবন গেল। মানুষের মৃত্যুও এদের ভাবায় না, কত পাশবিক!

টিভি সেন্টারের পাশে শুনশান নীরবতা। ঘড়িতে ২টা ১৩ মিনিট, দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে, গরম পড়েছে যেন গিলে খাবে! ওই যে ছোটবেলায় একটা বিজ্ঞাপন দিত না? সূর্য মাথার মগজ চুষে খাচ্ছে?

“বেশি আগে চলে এলাম না?”
আদিব আর আরাফাতের উদ্দেশ্যেই প্রশ্নটা করলাম।
“চুপ থাকবি?” ঝাঁঝালো কন্ঠে আরাফাত বলল।

অপেক্ষা করছি কারও জন্য, কিন্তু কার জন্য? এমন যদি হয় জারিফের ফোনই ছিল না ওটা? কোনো প্র্যাংক কল ছিল? যদি কোনো লীগের পান্ডার কল হয়? ছ’মিনিট হয়নি, আমার মনে হচ্ছে আমি হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছি। রোদের তাপে ঝিম ধরা রাস্তায় পিঠে একটা হাত রাখল কেউ একজন। ভেজা হাত, ছ্যাঁত করে উঠলাম।

“কে? কে!”
“চিল্লাইয়েন না। আমি ফাহিম। ভাই পাঠাইছে।”

হ্যাংলা মতো একটা ছেলে, বয়স কম, কিশোর।
আদিব জিজ্ঞেস করল সন্তর্পণে, “জারিফ কই?”
“জানি না ভাই, আপনাদের এগুলা দিতে বলছে। আর রেডি থাকতে বলছে।”

ফাহিম আমাদের হাতে কয়েকটা কেরোসিনের বোতল, দিয়াশলাই আর বারুদের গুঁড়ো দিলো।
“আমার লগে আসেন।”

গেটের তালা আগেই ভাঙ্গা, পাশে পড়ে ঘুমাচ্ছে গার্ড। ঘুমটা জোর করেই পাড়ানো হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে।

“রেডি তোরা?”
“জারিফ!”

“কিছু শাস্তি তো ওদের পাওনা আছেই!”
নীল রঙের পাতলা টি-শার্টে জারিফকে রোদের ছায়ায়ও অন্ধকার দেখাচ্ছে। আগেও সে এটা পরত, আমরা মানা করা সত্ত্বেও। এই রংটা ওকে মানায় না।

“গার্ড ঘুমাইতেছে, বার্গার খাওয়াইছি!”

জারিফ হেসে উঠলো, আমরাও ছোটখাটো আনন্দ করলাম কয়েক লহমার জন্য।

টিভি সেন্টারের দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে যেতে যেতে, আমার শ্বাস ভারি হয়ে আসে। হাতে কেরোসিনের বোতলটা যেন একেকটা বোমা। জারিফ পেছন থেকে কানে কানে বলল, “সতর্ক থাকবি। যদি কোনো পুলিশ দেখে ফেলে আর গুলি চালায়, পিছপা হইস না।”

আমি চমকে উঠি—গুলি?

ফাহিম তখনো সামনে হাঁটছে। হঠাৎ থেমে যায়।

“এই যে জায়গাটা, এখানেই কন্ট্রোল রুম। আগুন লাগলে পুরো ভবন ছড়ায় যাবে।”

আমরা কেরোসিন ছিটাতে থাকি। দেয়াল, জানালা, সিঁড়ির গোড়া—সব জায়গায়। চুপচাপ, নিঃশব্দে। শুধু গন্ধটা কটু হয়ে উঠছে।

একটা কাচের জানালায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি। রোদে স্পষ্ট না হলেও নিজের চোখের ভেতর একটা ভয় দেখতে পাই।

“তুই রেডি?” আদিব ফিসফিস করে।
আমি শুধু মাথা নাড়ি।

জারিফ দিয়াশলাই জ্বালায়, একটা কাঠি জ্বলে ওঠে, আর সাথে সাথে ছুঁড়ে দেয় দেয়ালে ছিটানো কেরোসিনের ওপর। আগুন এক মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে। লাল-কমলা শিখায় মুহূর্তেই চারদিক আলোকিত হয়ে যায়।

“ছুটব এখন সব” ফাহিম বলে।

ঠিক তখনই একটা গার্ডের চিৎকার—“কে ওখানে?”
আমরা দৌড় দিই। কিন্তু গুলির শব্দ আসে পেছন থেকে।

“উঃ”—
“আদিব!”

আমরা ছুটে পাশের গলির দিকে ঢুকে পড়ি। আগুনের প্রতিফলন তখনো আকাশে জ্বলছে। কিছুক্ষণ পর পেছনে দেখি, বিটিভির ছাদ থেকে ধোঁয়া উঠছে। আগুন এখন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমি একবার থামি, শ্বাস নিতে। মনে হয়, কিছু চিরতরে বদলে গেল। আর কিছুই আগের মতো থাকছে না।

“আসলে আমরা কী করলাম?” আমি ফিসফিস করে বলি।
জারিফ বলে, “শুরু মাত্র। এটা তো ট্রিগার।”
“আদিবকে হাসপাতালে নেওয়া লাগবে!” আরাফাত চিৎকার করে ওঠে।
“সময় নাই! বের হ!”

জারিফ আমাদের ধাক্কা দিয়ে বের করে আনে ভবন থেকে। ধোঁয়ার অসভ্য দুর্গন্ধে চোখ, নাক বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। আদিব বিস্ফোরিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার মনে হয় যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে!

“আদিব!”
না, আমার স্বর পৌঁছায় না আদিব পর্যন্ত। এক পায়ে গুলি নিয়ে আদিব অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গলতে থাকে ধোঁয়ায়।

জোবায়েদা আক্তারের দিনলিপি

একটু আগে সে কী কাণ্ড হয়! হঠাৎ দেখি, কোথা থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! কিন্তু আশ্চর্য! মানুষের কোনো পরোয়া নেই। রামপুরা পুলিশ বক্সে কে বা কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, ভেতরে কারও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা এখোনো জানা যায়নি। ভাগ্যিস রিফাতের আব্বু বাসায়, আজকে ডিউটি নেই, না হয় আল্লাহই জানে কী হতো। রিফাতটা যে কোথায় গেছে জানি না, চলেই আসবে হয়তো। রিফাতের আব্বুর এ কয়েকদিন বেশ চাপ যাচ্ছে, সামিনের কোচিং প্রতিদিন। আসেও দেরি করে, রাস্তাঘাটে কী হয় ভয় লাগে। আমার…

হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুরে তাকান জোবায়েদা আক্তার। রবিউল ইসলাম দ্রুত ফ্ল্যাটে ঢোকেন, পোশাক পরেই বেরিয়ে যেতে থাকেন। চোখে-মুখ ভরে গেছে ভীতি আর রাগে। ঘাড়ের রগ ফুলে গেছে, গাল রক্তিম হয়ে আছে ঘৃনার কারণে। চোখগুলো ছটফট করছে ভয়ে, ভয়েও রাগ ওঠে? রবিউল ইসলামকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।

“কই যাচ্ছ এখন!”

“সেটা তোমার ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেই পারো!”

ধমক দিয়ে বেরিয়ে যান রবিউল সাহেব।

রাস্তায় শ’ শ’ মানুষের ঢল, “স্বৈরাচার দমন করো”, “আমার ভাই মরল কেন?” স্লোগানে পুলিশ ফাঁড়ির দিকে এগুচ্ছে মানুষ। সদ্য নিভে যাওয়া আগুনে এখনো পোড়াগন্ধ। হাতে কিছুই নেই কারও, কেবল মুখে অন্যায় না মানার সাহস।

“ফায়ার!”

অবিশ্রান্ত গুলিতে ছেয়ে যায় রাস্তা। পাখির মতো গুলি চালান রবিউল সাহেব, সামনের সারিতে থাকা কয়েকটা ছেলে পড়ে যায় মাটিতে। একজন বয়স্ক লোক পড়ে যায় ওভারব্রিজের সিঁড়িতে, উনি কি জানতেন কী হচ্ছে? একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়েছিলেন মসজিদ থেকে, ডায়াবেটিস আছে, প্রতিদিন সকালে হাঁটতেন। কুঁচকি থেকে অনর্গল রক্ত বেরুচ্ছে, লাল রঙে ভেসে যাচ্ছে ওভারব্রিজের সিঁড়ি।

উত্তেজিত জনতা এগিয়ে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ির দিকে, ওয়াকিটকিতে রবিউল সাহেব চিৎকার করে ওঠেন, “আরও চালাও! আরও চালাও!”

পৃথিবীর সকল ঘৃণা এবং হিংস্রতা যেন রবিউল সাহেবের চেহারায় এসে জমেছে। তার এবং একটা হিংস্র পশুর মধ্যে পার্থক্যটা মুছে গিয়েছে। আন্দোলনকারীরা তার কাছে মানুষ না। রাস্তার কুকুরের সাথেও কেউ এমন আচরণ করে না, যেমনটা তিনি গতরাতে এক ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের সাথে করেছেন। ছেলেটি রোগা মতো, গায়ের রং চাপা। ইস্ট ওয়েস্টে পড়ে, আফতাবনগরের দিকে এক ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানেই গতকাল রাতে ব্লকরেইডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবিউল ইসলাম। ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে জিপে তুলেছেন তিনি নিজে। বেড়ধক মার খাওয়ার সময়েও পরনের লুঙ্গিটা সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল ছেলেটা। ঐ এলাকা থেকে আরও ৭-৮ জন ছেলেকে জিপে করে রামপুরা থানার হাজতে পুরেছিলেন রবিউল সাহেব। ছেলেটাকে মেরেছিলেন তিনি নিজেই। প্রথমে এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড়, এরপর বুটের লাথি ও লাঠির মার। দ্বিতীয় থাপ্পড়েই ছেলেটার ঠোঁট কেটে রক্ত বেরুচ্ছিল। ছেলেটার ভাবলেশহীনতা দেখে রবিউল সাহেবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বুকে-পেটে-পিঠে বুট দিয়ে লাথি দিতে লাগলেন। একপর্যায়ে ছেলেটা রক্তবমি করা শুরু করল। রবিউল সাহেব থামলেন না। কীটপতঙ্গকে মানুষ যেমন নির্দয়ভাবে মারে, ঠিক সেভাবে লাঠি দিয়ে মারলেন ছেলেটাকে। কতক্ষণ মেরেছেন খেয়াল নেই। শুধু মনে আছে ছেলেটা একবার তার দিকে এক হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল সে চোখে। ঐ চোখে চোখ মেলানো দায়। লাঠি দিয়ে মাথায় বেশ কয়েকটা বাড়ি মারাতে চোখ দুটো যেন ঘোলা হয়ে গেল। ক্লান্ত হয়ে রবিউল ইসলাম সেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে আর ঐ সেলে ঢোকা হয়নি তার। শায়েস্তা করার আরও কয়েকটা বাকি ছিল।

“আব্বু! আমার বুকে চালাও!”- চিৎকারে সম্বিৎ ফিরল রবিউল সাহেবের। হতবিহ্বল হয়ে যান তিনি। গাড়ি থেকে দেখার চেষ্টা করেন দূরবীন দিয়ে।

“সামিন!”

“কোচিং এ এসেছি, ন্যায়ের কোচিং। তুমি তো করবে না।”

“ঠাট্টা বাদ দাও, বাসায় যাও।”

রবিউল সাহেব গাড়ি থেকে নেমে আসেন। অবিরাম গুলি চলছেই, ধোঁয়ায় ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছেন না। হাতড়ে হাতড়ে এগুতে থাকেন সামনে। অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া আর গুলিবর্ষণের ধোঁয়া মিলে একাকার হয়ে গিয়েছে, রাস্তাজুড়ে ধূসর রঙের মেঘ, তন্মধ্যে কয়েকজন তরুণ আর একজন বৃদ্ধের রক্ত রঙিন করে তুলেছে পরিবেশ। হলিক্রস স্কুলের পোশাকের মতো, ধূসরের সাথে লাল; সুন্দর মিশ্রণ।

“তুমি বাসায় যাও বাবা।”

কাশতে কাশতে বললেন রবিউল সাহেব, সামিনকে ছোঁয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। গুমোট ধোঁয়ায় হাতড়ে হাতড়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ অনুভব করলেন ঘাড়ে সজোরে লাঠির আঘাত!

“মার শালাকে! মার!”

একাধিক কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে একই লাইন, “কত খুন করবি আমাদের ছেলেদের? কত খাবি? মার শালাকে!”

রবিউল সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না কী অবস্থায় আছেন। তিনি কি বসে আছেন? শুয়ে আছেন? নাকি দাঁড়িয়ে আছেন? মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে আঘাতের পর আঘাতে, কোনোরকম হাতের দিকে তাকান তিনি, সবুজ রঙের শার্টের হাতা ছিঁড়ে গেছে, ভেতরে ফুলে আছে পেশি, কালশিটে দাগ পড়েছে। মনে পড়ছে একদিন আগেই রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে থাকা কয়েকটা ছাত্রকে এভাবেই পিটিয়েছিলেন তিনি, ওদের হাতে-পায়ে এমনকি গোপন জায়গাগুলোতে এরকম দাগই পড়েছিল। ওদের চেহারাগুলো ভেসে উঠছে রবিউল সাহেবের চোখের সামনে। গতরাতের সেই ছেলেটার চোখদুটো মুহূর্তেই মনে পড়ে আবার মিলিয়ে গেল। চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু ধোঁয়া আর অশ্রুর কারণে কাউকে চিনে উঠতে পারেন না। মানুষের চিৎকার ম্লান হতে থাকে কানে, কাঁসার বাসনের মতো শব্দ লাগে।

“আংকেল, জমি দিয়ে দিয়েন!”

দুড়ুম করে একটা আঘাত পান মুখের ওপর, ঠোঁট আর নাক ফেটে রক্ত বেরুতে থাকে রবিউল সাহেবের। ঘোলা দৃষ্টিতে দেখতে পান নীল রঙের শার্ট পরা একটা ছেলেকে, মাথায় আর গলায় আঘাত করেই যাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখেছেন কোথাও… রিফাতের সাথে… কী যেন ‘জ’ দিয়ে নাম না? কী নাম? মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে রবিউল সাহেবের। কিছু একটা দেখে চোখ দু’টো বের হয়ে আসতে চায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেন ভয়ে। বমি করতে থাকেন।

সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। যদি সূর্যের প্রাণ থাকত, সেও জানত বাংলাদেশের রাস্তায় তার মতোই আভা। সূর্যের দিকে এক উলঙ্গ পুলিশের উঁচিয়ে ধরা লাশ আর সাধারণ মানুষের উল্লাসধ্বনি।

“আপনারা যা করেছেন এবং এখনো করছেন তার জন্য এতটুকু আপনাদের প্রাপ্য।”

“আর কে কে ছিল তোর সাথে? নাম বল!”

“সেটা জেনে কী করবেন?”

“ছোট শয়তানের হাড্ডি! কোথায় পড়াশুনা করবে, কোচিং-এর নাম দিয়ে রাস্তায়, হ্যাঁ? কে বুঝাইছে এগুলা? নিজের বাপের চেয়েও সন্ত্রাস বড় তোর কাছে?”

“কোচিং-এ কীভাবে যাব আংকেল? আমার বন্ধুদের গুলি মেরে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন তো আপনারাই।”

“শোন শয়তানের বাচ্চা…”

সার্জেন্ট বাহার সামিনের গলায় চাপ দিয়ে বলেন, “আমার এই পোশাকের দাম আছে না? এই পোশাক আমাকে এমনি এমনি দেওয়া হয় নাই। তোদের মতো চুনোপুঁটি শেষ করা আমার দায়িত্ব। বন্ধুর ছেলে জন্য গায়ে এখনো হাত তুলি নাই।”

সন্তর্পণে বাসায় এসে ঢুকি, আম্মু দেখলে আমি শেষ। ঘেমে গেছি, চোখ-মুখ জ্বলছে, গোসল করে শুয়ে পড়তে হবে। আব্বুর মৃত্যুসংবাদ এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা, না জানি কী অবস্থায় দেখব আম্মুকে।

“ধুর!”

দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আম্মু ছুটে এলো আমার কাছে।

“রিফাত!”

“আ-আমি রাস্তায় আটকা পড়েছিলাম, মানে…”

“আমাদের সম্পদগুলোর কী হবে! তুই জলদি একটা ব্যবস্থা কর!”

আম্মুকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এ-ই কিনা সে নারী যে আব্বুর জন্য সবকিছু দিয়ে দিত। আব্বু-আম্মুর অসংখ্য অনলাইন-অফলাইন ছবি, আব্বুর দুর্ব্যবহারের পরেও আম্মু নাকি আব্বুকে ভালোবেসেই থেকে গেছে। এটা আবার কোন আম্মু!

শান্তভাবে বললাম, “আমাদেরগুলো আমাদেরই থাকবে। চিন্তার কী আছে?”

“গাধা নাকি তুই? এখনো সবারটা নিজেদের নামে নেওয়া হয়নি, তোর বন্ধু জারিফের বাপ কি কম মামলা দিলো? আরও কত মামলায় আটকে আছে দোকান-জমি-প্লট। এগুলোর কী হবে?”

“এগুলো তো আমাদের না, যারটা সে নিবে সমস্যা কী?”

“হায়রে গাধা!”

আম্মু ডুকরে কেঁদে উঠল হঠাৎ করে। কী জন্য কে জানে। আমি আব্বুর মতো হইনি এ-কারণে, নাকি বেশি সত্য বলে ফেললাম এ-কারণে? আম্মুর কান্না কমে এলে বললাম,

“সামিন থানায়।”

“ওহ আল্লাহ গো! ও আবার কী করল!”

আম্মু আরেকবার সজোরে চিৎকার করে উঠল, এই মুহূর্তে আমার আসলে বিরক্ত লাগছে। আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোর বাপের পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে আন, জলদি যা!”

“হবে না। কোচিং থেকে রেগুলার প্রটেস্টে গেছে, ওকে ছাড়ানো যাবে না।”

“শেষ পর্যন্ত আমার ছেলেও সন্ত্রাসী! হায় আল্লাহ!”

“সবাই সন্ত্রাসী না আম্মু…” ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “ব্র্যাকইউ’র সামনে ছোট একটা স্টল দিয়েছিল জারিফ মনে আছে? ইন্টারের পর চান্স না পেয়ে আমি যখন ভর্তি হলাম ব্র্যাকে তখন। ও সবসময় একটা কথা বলত, বার্গার মুখে দেওয়ার পর কেউ বুঝবে না ভেতরে কী দেওয়া, সব মিশে একাকার হয়ে স্বাদ তৈরি করে – এমন টাইপ কিছু। আব্বুর মাথার খুলিতে আঘাতটা ও-ই করেছে, ওকেও ধরেছে পুলিশ। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব থাকলেও, যেটা তুমি ‘আমাদের সম্পদ’ বলে দাবি করো, সেগুলোর ভেতরে ওদেরটাও তো আছে তাই না? ক্ষোভ তো তারও ছিল। আব্বুকে মৃত্যু-আঘাত করার জন্য কি তুমি ওকে সন্ত্রাসী বলতে চাও?”

আম্মু রাগে উত্তেজিত হয়ে বলল, “ও সন্ত্রাসী না তো, কে সন্ত্রাসী?”

“সেটা তো বুঝলাম তবে, সন্ত্রাসী তো সামিনও তোমার চোখে, তাই না?”

“হ্যা কিন্তু…”

“এত মানুষের অধিকার ভক্ষণ করে, শ’খানেক নিষ্পাপ মানুষ মেরে, নিরপরাধ শান্তিপূর্ণ ছাত্র, যারা তোমার ছেলের মতোই, আমারই বন্ধু-ভাই-প্রতিবেশী খেলার সাথি, ওরা অন্যায় কোটার প্রতিবাদ করায় ওদের হত্যা করেও আব্বু ভালোমানুষ। আর এই কথাগুলো বলে, ন্যায়ের পক্ষে রাস্তায় নেমে সামিন সন্ত্রাসী। তাই না?”

“বুঝলাম না তোর কথা।”

“যদি এই জালিমদের মানুষ নামিয়ে ফেলে, নতুন স্বাধীনতার স্বাদ সুস্বাদু হবে। কে কোন উদ্দেশ্যে তা আনতে কাজ করেছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, যেমন বার্গারের সসগুলোকে আলাদা করা যায় না। সব মিলেমিশে যায়, জিহ্বায় ভালো লাগে।”


by

Tags: