আচ্ছা, ছাত্রজীবন মানেই কি রাতদিন এক করে পাঠ্যবইয়ে ডুবে থাকা? কিংবা জীবনের সব আনন্দকে বিদায় জানিয়ে একঘেয়েমি পড়াশোনার যিকির তোলা?
না ভাইয়া, ছাত্রজীবন মোটেই এরকম রসকষহীন কোনো ব্যাপার নয়। ছাত্রজীবন অসাধারণ একটি সময়। এর প্রতিটা মুহূর্ত চুটিয়ে উপভোগ করা যায়। তবে ছাত্রজীবনকে উপভোগ্য বানিয়ে তুলতে হলেও কিন্তু কিছু ব্যাপারস্যাপার মেনে চলতেই হয়। নইলে যে আবার উপভোগের ব্যাপারটা উদাসীনতার পর্যায়ে চলে যাবে!
তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় তুখোড় হবে। প্রচুর পড়াশোনা করবে, আবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতেও যাবে। খেলাধুলা করবে, নিয়ম করে ব্যায়ামও করবে। শরীরের জন্য উপকারী এমন প্রচুর ভালো খাবার খাবে। তুখোড় হতে হলে রোবট হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, তাই না!
তোমার রোবটিক ছাত্রজীবনকে ‘প্যারা নাই, চিল’ টাইপ সুখের জীবনে পরিণত করতে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সেগুলো হলো :
১. স্ক্রিন আসক্তি থেকে চিরস্থায়ী অবসর
২. রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া
৩. ভোরে জেগে উঠা
৪. পড়াশোনায় কৌশলী হওয়া
৫. নিয়মিত খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করা
৬. খাদ্যাভ্যাসের মান-উন্নয়ন
এই ছয়টা বিষয়ে ছোটখাটো কিছু লেকচার দিই! অন্তরে গেঁথে নিয়ো। ইন শা আল্লাহ, উপকৃত হবে।
১. স্ক্রিন আসক্তি থেকে চিরস্থায়ী অবসর
স্মার্টফোনের সাথে অতিরিক্ত সুসম্পর্ক করতে গেলেই জন্ম নেয় ‘স্ক্রিন আসক্তি’ নামক এক ইডিয়ট। হ্যাঁ, ইডিয়ট। এই ইডিয়ট তোমার আচার-আচরণ এবং মেজাজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এমনকি এই স্ক্রিন আসক্তি তোমার মস্তিষ্কের গঠনও পালটে ফেলতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ক্রিন আসক্তির কারণে মস্তিষ্কের আয়তন কমে ছোট হয়ে যায়। এতে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। এ ছাড়া স্ক্রিন আসক্তির কারণে রাতে ঠিকভাবে ঘুম হয় না। ফলে জন্ম হয় হতাশা, দুশ্চিন্তা, কিচ্ছু ভাল্লাগে না, মেজাজ খিটখিটে ইত্যাদি জনপরিচিত রোগের।
তাই কোনোভাবেই স্ক্রিন আসক্ত হওয়া যাবে না। প্রয়োজনে অল্প কিছু সময় ব্যবহার করতে পারো। আর যদি ইতোমধ্যে তুমি আসক্তির ফাঁদে পা দিয়ে থাকো, তা হলে আজকেই একে বিদায় করো। স্মার্টফোনের আনস্মার্ট ব্যবহার থেকে অবসর নাও, চিরস্থায়ী অবসর। নো কম্প্রোমাইস!
২. রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া
ছোট্টকালে একটা কবিতা পড়েছিলাম,
Early to bed
And early to rise
Makes a man healthy
Wealthy and wise.
এই কবিতার কবি কে, জানি না। তবে তিনি সত্য বলেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যারাই ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের জীবনী পড়লে দেখবে, তাঁদের অধিকাংশই রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তেন। আমাদের প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাই বলি। তাঁর অভ্যাস ছিল, রাতের শুরুভাগে ঘুমিয়ে যেতেন আর শেষভাগে জেগে উঠতেন এবং সালাত আদায় করতেন। (বুখারি, ১১৪৬, সহীহ)
দ্রুত ঘুমানোর উপকারিতা আধুনিক কালের বিজ্ঞানও স্বীকার করে। বিজ্ঞান বলছে, আমাদের শরীরে রাত ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে মেলাটোনিন (Melatonin) নামক একটি হরমোন নিঃসরণ হতে থাকে। মেলাটোনিন কী করে আমাদের? ঘুম আসতে সাহায্য করে। অর্থাৎ, প্রতিদিন এই সময়ে আমাদের ঘুম পায়। আমাদের শরীরের ফাংশনটা আল্লাহ এভাবেই করেছেন। তিনি রাতকে আমাদের জন্য বিশ্রামের আবরণ বানিয়েছেন। (সূরা ফুরকান, ২৫ : ৪৭)
তা ছাড়া দ্রুত না ঘুমালে ঘুম পরিপূর্ণ হয় না। আর ঘুম পরিপূর্ণ না হলে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। দুশ্চিন্তা বাড়লে প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। বিপরীতে বেড়ে যায় হতাশা। আর হতাশার পরের ধাপ তো তুমি জানোই। আত্মহত্যা প্রবণতা।
ঘুমের ঘাটতি হলে ধীরে ধীরে রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
তাই, দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলো। এর জন্য স্ক্রিন আসক্তিকে বিদায় করা জরুরি। কেননা, স্মার্টফোন থেকে যে নীল রশ্মি (Blue Ray) আসে, এটা আমাদের মস্তিষ্কে মেলানোপসিন (Melanopsin) নামক হরমোন নিঃসরণ করে। এটা মেলাটোনিন এর ঠিক বিপরীত। মেলাটোনিন ঘুম আসতে সাহায্য করে, আর মেলানোপসিন ঘুম তাড়াতে সাহায্য করে। অতএব, দ্রুত ঘুমাতে হলে স্ক্রিন আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি।
৩. ভোরে জেগে উঠা
বিজ্ঞান বলছে, ভোর চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে আমাদের শরীরে কর্টিসল (Cortisol) লেভেল বাড়তে থাকে। কর্টিসল লেভেল বাড়া মানেই হচ্ছে, ওই সময় আমাদের উচিত ঘুম থেকে উঠে একটিভ হয়ে যাওয়া।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সময়টা ফজরের আশপাশ। অর্থাৎ, ফজর ঘনিয়ে এলে তোমার শরীর তোমাকে এলার্ম দেবে যেন তুমি জেগে উঠো। কী অসাধারণ বডি ফাংশন! সুবহানাল্লাহ!
তুমি ফজরে জেগে উঠার অভ্যাস রপ্ত করো। ফজরের সালাতে মাসজিদে জামাআতে শরিক হও। তা হলে তুমি আল্লাহর যিম্মায় চলে যাবে। (ইবনু মাজাহ, ৩৯৪৬, সহীহ)
মাঝেমধ্যে ফজরের একটু আগে উঠো। অল্প সময় কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) আদায় করো। হোক তা মাত্র দুই রাকাআত। এই সময় আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, ‘কে আছে এমন, আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দেবো…।’ (বুখারি, ১১৪৫, সহীহ)
আল্লাহর কাছে চাও। একজন ছাত্র হিসেবে আল্লাহর কাছে অনেক কিছু চাওয়ার আছে তোমার।
এই ফায়দাগুলো পেতে হলে অবশ্যই ভোরে জেগে উঠার অভ্যাস করতে হবে। আর ভোরে জেগে উঠার জন্য অবশ্যই রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে হবে।
৪. পড়াশোনায় কৌশলী হওয়া
ছাত্রজীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পড়াশোনায় কৌশলী হওয়া। দিনের সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ সময়কে পড়াশোনার জন্য বাছাই করা। কিন্তু দিনের মধ্যে সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ সময় কখন?
ফজরের পর। ইসলাম ফজর-পরবর্তী এই সময়টাকে অনেক গুরুত্ব দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে দুআ করেছেন, যেন তিনি তাঁর উম্মাহকে এই সময়ে বারাকাহ দান করেন। (সুনানু আবী দাঊদ, ২৬০৬, সহীহ)
বিজ্ঞানও বলে, ভোর ৪ টা থেকে সকাল ৮/৯ টা পর্যন্ত আমাদের প্রোডাক্টিভিটি সবচেয়ে বেশি থাকে। এই সময়ে তুমি এক ঘণ্টায় যা পড়তে পারবে, দিনের বাকি সময়ে সেই একই পড়া পড়তে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। তার মানে, তুমি যদি ভোরে ৩/৪ ঘণ্টা পড়ো, তাহলে সারাদিনে ১৬/১৭ ঘণ্টা পড়লে যেই উপকার হবে সেই উপকার পেয়ে যাবে।
তুমি কৌশলী হও। প্রোডাক্টিভ হও। ফজরের পরপরই পড়তে বসো। নিয়মিত একটু একটু করে পড়লেও সপ্তাহ বা মাস শেষে দেখবে, পড়াশোনা অনেক এগিয়ে গেছে। ফজরের পর জেগে থাকতে একটু সমস্যা হতে পারে প্রথম কয়েকদিন। মাথা ঝিম ঝিম করতে পারে। এরকম করলে বাহির থেকে একটু ঘুরে আসবে। চা খাবে। কিছুদিন গেলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
৫. নিয়মিত খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করা
মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করবে। এতে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকবে। চাইলে খালি হাতের সাধারণ ব্যায়ামগুলো করতে পারো। যেমন- হাঁটা, জগিং, বুকডন (পুশআপ), দড়ি খেলা, সাঁতার ইত্যাদি। নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী। খেলাধুলা বা শরীরচর্চার জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হলো বিকেল বেলা। এ সময় শরীরের মাসল একটিভ থাকে।
শরীর ফিট রাখার জন্য শরীরচর্চার বিকল্প নেই। ইসলামেও শরীর ফিট রাখার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘(দেহমনে) শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিন অপেক্ষা বেশি প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে…।’ (রিয়াদুস সালিহীন, ৬/১০২)
শরীর ফিট থাকলে মন ফুরফুরা থাকে। তখন পড়াশোনায় সহজেই মন বসে। আবার খেলাধুলা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে পড়াশোনার একঘেয়েমি ভাবটাও কেটে যায়।
৬. খাদ্যাভ্যাসের মান-উন্নয়ন
শরীর ফিট রাখার জন্য শরীরচর্চার পাশাপাশি ভালো খাবার খাওয়াও জরুরি। ফাস্ট ফুড নামক অখাদ্য খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। বেশি বেশি শাকসবজি খেতে হবে। এ ছাড়া দুধ, ডিম, মাছ, কিশমিশ, বাদাম, কলা, মধু, কালোজিরা, গাজর, মৌসুমি ফলমূল ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারো। এই খাবারগুলো সহজলভ্য এবং বেশ উপকারী। আর পানি খেতে হবে প্রচুর পরিমাণ।
এই ছয়টি বিষয় আয়ত্ত করতে পারলে তোমার ছাত্রজীবনও হয়ে উঠবে অসাধারণ, ইনশাআল্লাহ। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখবে, সবগুলো অভ্যাস একদিনে আয়ত্ত হবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে মান-উন্নয়ন করতে হবে। ইনশাআল্লাহ, একদিন তুমিও বলবে—মেনে চললে নিয়ম, ছাত্রজীবন সত্যিই সুখের জীবন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
[পুরো লেখার বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো ডা. নাবিল এর ‘২৪ ঘণ্টা সময়কে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগানোর কৌশল’ শিরোনামের ভিডিও থেকে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।]
[প্রবন্ধটি ষোলো দ্বিতীয় সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০২২) প্রকাশিত।]
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.