ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলাম। এরপর কী যে হলো, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। একের-পর-এক রেজাল্ট খারাপ হতে থাকল। ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় তিনটা সাবজেক্টে ফেইলই করে বসলাম। বাবা বলল আমাকে অটো কিনে দেবে… আর পড়াশোনা করাবে না। মা আমার পিঠে ঝাড়ু ভাঙ্গার আর পাশের বাড়ির মেহেদীর পা ধোয়া পানি খাওয়ানোর ইচ্ছা পোষণ করল। এ সময় আমার জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে হাজির হলো ফুপাতো ভাই হাসান। আমাকে বেশ কিছু টিপস দিলো সে। সেই টিপস ফলো করে এর পরের পরীক্ষাগুলোতে একের-পর-এক ছক্কা হাঁকাতে থাকলাম আমি। সেই টিপসগুলোই তোমাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার করছি আমি। আগের পর্বগুলো না পড়ে থাকলে পড়ে নাও দ্রুত।
আমার পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল পড়াশোনায় মনোযোগ না বসা। বসবে কীভাবে? আমার পড়ার পরিবেশ ছিল এক্কেবারে সদরঘাট। পড়ার টেবিলে রাজ্যের আজেবাজে জিনিস দিয়ে ভর্তি থাকত। প্রতিদিন ভাবতাম আজকে কুত্তা পড়া পড়ব, একেবারে ফাটায়ে ফেলব। একবুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে পড়তে বসার পর পড়ার পরিবেশ না থাকায় পড়ার ইচ্ছেই যেত মরে। পড়তে বসে একটু গল্পের বই পড়তাম, একটু রুবিক্স কিউব নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, ‘একটু’ ফোন টিপতাম। আর এভাবেই প্রতিদিন পড়া বাদে আজেবাজে বাকি সব কাজ হতো। আর সব পড়া জমে থাকত পরীক্ষার আগের রাতের জন্য। পরীক্ষার আগের রাতে নাকে-মুখে পড়া গিলে বদহজম হয়ে যেত আর পরীক্ষায় পেতাম আন্ডা।
কিন্তু হাসান ভাইয়ের দেওয়া টিপসগুলো ফলো করে আমি পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করি। আমার পড়াশোনায় মনোযোগ আসে আর প্রতি পরীক্ষায় বাজিমাত করতে থাকি। সেই টিপসগুলোই আজ তোমাদের সাথে শেয়ার করব।
স্মার্ট স্টুডেন্টের মতো পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি ও পড়ায় মনোযোগ আনবে যেভাবে—
১. পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখো
একটা গোছানো, পরিপাটি টেবিল তোমার পড়ার মানসিকতা অনেকটাই বদলে দিতে পারে। পড়ার সময় যদি টেবিলের চারপাশে বই, নোট, কলম ছড়ানো-ছিটানো থাকে, তাহলে মনোযোগ হারানোর সুযোগ অনেক বেশি। তাই—
- পড়ার টেবিলে শুধু দরকারি বই, খাতা, কলম রাখো।
- অপ্রয়োজনীয় জিনিস—যেমন মোবাইল, খেলনা, ম্যাগাজিন, অযথা কাগজপত্র সরিয়ে ফেলো।
- প্রতিদিন পড়া শুরু করার আগে টেবিল পরিষ্কার করো, এতে তোমার মনোযোগ দ্রুত পড়ায় ফিরে আসবে।
২. পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখো
খেয়াল করে দেখবে, অনেক সময় হালকা আলোতে পড়তে গেলে চোখ ব্যথা করে, মাথা ধরে আসে। এর কারণ হলো কম আলোতে চোখের উপর বেশি চাপ পড়ে, ফলে তুমি দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ো। তাই—
- পড়ার সময় সবসময় পর্যাপ্ত আলো ব্যবহার করো।
- সম্ভব হলে দিনের বেলা জানালার পাশে বসে পড়ো, এতে প্রাকৃতিক আলো কাজে লাগবে।
- রাতে পড়ার সময় টেবিল ল্যাম্প ব্যবহার করো, কিন্তু ল্যাম্পের আলো যেন সরাসরি চোখে এসে না লাগে।
৩. পরিবেশ তৈরি করো
পড়তে বসার সময় যদি পাশের ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসে, বাইরের গাড়ির হর্ন বাজতে থাকে, বা ছোট ভাইবোনরা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করতে থাকে—তাহলে পড়ায় মনোযোগ রাখা অসম্ভব হয়ে যায়। তাই—
- একদম শান্ত, নিরিবিলি জায়গায় পড়ার ব্যবস্থা করো।
- বাসায় শব্দ হলে ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করো।
- দরজা বন্ধ করে পড়তে বসো এবং পরিবারকে জানিয়ে দাও যেন এই সময়টায় তোমাকে ডিস্টার্ব না করে।
৪. পড়ার নির্দিষ্ট সময় ঠিক করো (ব্রেইনকে ট্রেইন করো)
এলোপাথাড়ি সময়ে পড়লে তোমার মস্তিষ্ক কখন পড়তে হবে সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। ফলে পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই—
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সময় পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখো। যেমন, ফজরের পর ২ ঘণ্টা, বিকেলে ১ ঘণ্টা, এবং রাতে ২ ঘণ্টা।
- নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করলে পড়ার সময় মনোযোগ দ্রুত ফিরে আসবে।
৫. ফোন দূরে রাখো (পড়ায় মনোযোগ আনার জন্য এটা ফরজ)
ফোনের নোটিফিকেশন একবার দেখলেই পড়ার ফোকাস নষ্ট হয়ে যায়। তুমি হয়তো ভাবছো–‘শুধু একবার মেসেজ দেখব’, কিন্তু এরপর সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং করতে করতে কত ঘণ্টা যে পার হয়ে যাবে বুঝতেও পারবে না। তাই—
- পড়ার সময় ফোন সাইলেন্ট মোডে রাখো বা অন্য ঘরে রেখে দাও।
- সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো পড়ার সময় ব্লক করে রাখতে পারো।
- জরুরি দরকার না হলে ফোন ব্যবহার করবে না।
৬. পড়ার সময় পর্যাপ্ত পানি পান করো
পানির অভাবে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যায়, ফলে পড়ার সময় আমাদের দ্রুত ক্লান্তি আসে। তাই—
- পড়ার টেবিলে একটি পানির বোতল রাখো।
- ৩০-৪০ মিনিট পরপর অল্প করে পানি পান করো।
- কফি বা এনার্জি ড্রিঙ্কের উপর নির্ভর না করে শুধু পানি পান করো।
৭. পড়ার সময় ছোট ছোট ব্রেক নাও
একটানা অনেকক্ষণ পড়লে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে যায়। পড়ায় মনোযোগ কমে যায়। গবেষণায় জানা গিয়েছে, মানুষের মস্তিষ্ক ২৫-৪৫ মিনিটের বেশি টানা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তাই—
- প্রতি ৪৫-৫০ মিনিট পড়ার পর ১০-১৫ মিনিটের ব্রেক নাও।
- ব্রেকের সময় হালকা হাঁটাহাঁটি করো বা চোখ বন্ধ করে পাওয়ার ন্যাপ নাও।
- চকলেট, বাদাম বা খেজুরের মতো হালকা নাশতা খেতে পারো, যা তোমাকে দেবে ইন্সট্যান্ট এনার্জি।
৮. পড়ার টেবিলে ছোট গাছ রাখো (মন ফুরফুরে থাকবে)
গবেষণায় দেখা গেছে, পড়ার টেবিলে ছোট গাছ থাকলে মন শান্ত থাকে এবং ফোকাস বাড়ে। সবুজ গাছ মস্তিষ্ককে প্রশান্তি দেয় এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই—একটি ছোট গাছ পড়ার টেবিলে রাখো, যেমন মানি প্ল্যান্ট বা ক্যাকটাস।
৯. অনুপ্রেরণামূলক উক্তি রাখো
পড়ার সময় মোটিভেশন ধরে রাখতে তোমার পড়ার টেবিলে অনুপ্রেরণামূলক কিছু আয়াত, হাদীস ও উক্তি রাখতে পারো! তাই—স্টিকি নোটসে কিছু মোটিভেশনাল উক্তি লিখে পড়ার টেবিলে সেঁটে দাও। যেমন: ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ (আল-ইনশিরাহ: ০৫), ‘উট বেঁধে রাখো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করো।’ (তিরমিযি), ‘আজকের কষ্টই আগামীর সফলতা!’ বা ‘আমি পারবই ইনশাআল্লাহ!’ এগুলোয় চোখ বুলালে তোমার পড়ার আগ্রহ বাড়বে।
১০. সঠিক ভঙ্গিমায় বসো
ভুলভাবে বসলে শরীর ব্যথা করবে, ফলে পড়ার প্রতি অনীহা চলে আসবে। তাই—
- মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসো। টেবিল ও চেয়ারের উচ্চতা ঠিক রাখো।
- বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি চলে এলে উঠে দাঁড়াও, আড়মোড়া ভেঙে নাও বা কয়েকটা পুশ-আপ দিয়ে শরীরটা চাঙা করে নাও।
১১. পড়ার আগে দুআ পড়ে নাও
পড়া শুরুর আগে আল্লাহর কাছে দুআ করলে পড়ায় মনোযোগ ও সময়ে বারাকাহ আসবে। আল্লাহ সহজ করে দিবেন। মনে আত্মবিশ্বাস আসবে। তাই—
- পড়ার আগে নিয়মিত দুআ করো এবং পড়ার প্রতি আন্তরিক থাকো।
- ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পড়া শুরু করো।
পড়ায় মনোযোগ আনতে এই টিপসগুলোর এক ফাইল-ই যথেষ্ট। কাজ না হলে ষোলো ৯ম সংখ্যার টাকা ফেরত!