টিম বিচ্ছু: পর্ব ২
মাসনুনটা স্কুলে আসছে না কয়দিন, আসলেও আগে ভাগে চলে যায়। খেলতে গেলে ও বাড়ি যায় সবার আগে, আর ইদানীং মাঠেও ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফোন নেই। আন্টির ফোনে কল দিয়েও পাওয়া গেল না। খেলার মাঠটা বেশ জমেছে, ওরা ৫ জন ছাড়াও আরও ৫-৬ জন রেগুলার আসে খেলতে। মাগরিবের আযান পর্যন্ত চলে ওদের দৌড়ঝাঁপ। শীতকালে চলে ব্যাডমিন্টন আর বাকি দিন ফুটবল, না হয় ক্রিকেট।
‘মাসনুনকে দেখসিস কেউ তোরা?,’ বলে অরণ্য।
‘আরেহ, কোথাও গেছে মনে হয়, বেড়াইতে।’ সবাইকে নির্ভার করতে সাথে সাথেই বলে ফেলে আবিদ। যদিও গত দু’দিন মাসনুনের চিন্তায় ওর পড়ায় মন বসছে না।
- ও আর কোথায় যাবে? ওর তো দাদা, নানা বাড়ি সব কাছেই।
- দেখি তাহলে কাল স্কুলের পর ওর বাসায় একবার ঢু মেরে আসব, ইনশাআল্লাহ।
পরদিন বিকেলে আবিদ, নাবিল আর আরিফ মিলে যায় মাসনুনের বাসায়। দেখে নিচে কেঁচি গেট লাগানো। তবে বাসায় মানুষ আছে বোঝা যাচ্ছে। নিচ থেকে বেল দিতে বারান্দায় মাসনুনের ছোট ভাই এসে ঘুরে গেল। ওরা শুনতে পায় উপরে বেশ কথা কাটাকাটির আওয়াজ।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন ওদেরে পা প্রায় ধরে এলো, তখনি একজন এসে গেট খুলে দেয়।
‘আইয়েন আমনেরা, খালাম্মা রাইগা আছে!’ বলেই চলে গেল একজন লোক।
ওরা ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে তিন তলায়।
- আসসালামু আলাইকুম আন্টি, মাসনুন কোথায়?
- ও আছে ঘরে, তোমরা বসো এখানে। তোমাদের সাথে কথা আছে।
আন্টি কিছুটা ভয়, দুঃখ এবং অনেকটা রাগ রাগ কণ্ঠে বলা শুরু করলেন,
‘সেদিন তোমাদের ঐ মাঠের কাহিনির পর দিন থেকেই ঘটনা শুরু। মাসনুনের স্কুলে আসা যাওয়ার পথে একটা চিপা গলি পড়ে। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে আসার পথে ওখানে ওকে আটকায় ৪-৫ জন ছেলে। ওরা ঐ মাঠে নেশা করত। কলার ধরে ভীষণ বকাঝকা করে, তোমাদের নাম জানতে চায়। ও বলেনি দেখে ওকে একজন থাপ্পড়ও মারে।’
কান্না কান্না হয়ে যান আন্টি, ‘ও অনেক বলেছে তোমাদের সাথে একবার দেখা করতে দিতে, আমি বাবা ভয় পেয়েছি ভীষণ। তাই ওকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না।’
কয়েক মিনিটের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সবাই। ‘আন্টি, চিন্তা করবেন না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আজকে আমরা আসি তাহলে।’ শেষে এটা বলে আবিদ সবাইকে নিয়ে চলে আসে এলাকায়।
পরদিন স্কুলের টিফিন টাইমে ওরা তিনজন নাবিলকে সব কথা বলে। কারও মুখে হাসি নেই।
‘আমাদের কি কিছুই করার নেই? আজকেই চল ওদেরেকে ধরি!’ আরিফ হঠাৎ বলে।
‘কী করব বল, ওরা তো খারাপ লোক, আর মারামারি করে। ওদের সাথে কি পারা যায়?’ অরণ্য একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলে।
‘অন্যায়ের প্রতিবাদ তো অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু আমার মাথায়ও কিছু আসছে না। আবিদ কিছু বলবা না?’ – নাবিল আবিদের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে বসল।
এদিকে আবিদের মাথায়ও হাজার চিন্তা। একদিকে ও জানে বিপদে বন্ধুকে সাহায্য করতে হবে। আবার অন্যদিকে কিছু করতে গিয়ে সবাইকে না আবার বিপদে ফেলে। হাজার হোক মাঠ উদ্ধারের উদ্যোগ তো ওরই ছিল। আর তার কারণেই মাসনুনের এই বিপদ!
অরণ্য: তোরা যাই করিস, আমি এই ঝামেলায় নেই। কয়দিন পর এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
নাবিল: সবাইকে বিপদে ফেলা ঠিক হবে না।
‘আচ্ছা, আমাকে একটু সময় দে চিন্তা করার। বিকালে কথা বলি।’ এই বলে আবিদ ওইদিনের মিটিং শেষ করে দেয়।
খেলার মাঠে আবিদ, নাবিল, আরিফ হাজির। অরণ্যের খোঁজ নেই। নাবিল-ই শুরু করল কথা,
‘আমরা তো একটা টিম, তাই না? প্রতিটা টিমের একজন লিডার দরকার। যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে, কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক। আর বাকিরা তার কথা মেনে নিবে; পছন্দ হোক বা না হোক। আমাদের আজকের এই ঘটনায় আমরা বিভক্ত হয়ে গেছি আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার কেউ নেই বলে।’
- বেশির ভাগের কথা নিলেই সহজ না?’ আরিফ জিজ্ঞেস করে।
- না! কেননা, বেশির ভাগ লোক সব সময় সঠিক কথা বলবে না। যেমন আমরা বেশির ভাগ চাচ্ছি কিছু না করতে, ঝামেলায় না যেতে, সেটা ভালো ডিসিশন নাও হতে পারে।
- লিডার কি যা ইচ্ছা তাই করবে?
- তাও না, লিডার সুন্নাহর গাইডলাইন মোতাবেক লিড করবে। সবার সাথে পরামর্শ করবে, সবার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিবে। লিডারশীপ একটা দায়িত্ব, লিডারকে তার সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে আখিরাতে। আর বাকিদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে তারা লিডারের কথা মানল কিনা। তবে কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কিছু করতে বললে ভিন্ন কথা।
- ও আচ্ছা।
আবিদ কিছু বলছে না। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাবিলের কথা শুনছে, ওর ছোট ঘিলুতে এত চিন্তা কখনোই আসে না। আর কী সুন্দর করে কথা বলে নাবিল।
- ‘নাবিল-ই হোক আমাদের লিডার!’ আবিদ লফিয়ে উঠে বলে। ‘ওর অনেক জ্ঞান আছে মাশা-আল্লাহ!’
- উহু, শুধু জ্ঞান থাকলে হবে না। বুদ্ধি থাকতে হবে, সবার সামনে থেকে কাজ করতে হবে। আবিদ তুমি সবাইকে এক করে সেই মাঠ উদ্ধার করেছ। এখনো তুমি মাসনুনকে সাহায্য করতে চাচ্ছ। তুমি-ই প্রকৃত লিডার।
- ‘ইয়েস, ইয়েস’ এবার আরিফ সায় দেয়। ‘তুমি যা বলবা আমরা মানব ইনশাআল্লাহ!’
শুনে আবিদের মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পরে। ও কি পারবে? ওর তো নাবিলের মতো জ্ঞান নেই, অরণ্যর মতো মানুষের সাথে মিশতে পারে না ও। আরিফ, মাসনুনের মতো খেলাধুলাতেও এক্সপার্ট না। ও একজন মুখচোরা, মিডিয়াম স্টুডেন্ট।
সাথে সাথে ওর মনে হলো, আল্লাহ কাউকে সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেন না…
‘আচ্ছা ইনশাআল্লাহ, ঠিক আছে। তবে তোমাদের সবাইকে লাগবে আমার। আমরা কিছু একটা করব অবশ্যই, তবে মাথা গরম করে না। ফার্স্ট কাজ হলো অরণ্যর খোঁজ নেওয়া। তারপর সবাই মিলে প্ল্যান করব, ইনশাআল্লাহ।’
শিক্ষা: প্রতিটি টিমের একজন লিডার প্রয়োজন। তা ছাড়া টিম চলতে পারে না। লিডারকে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহর গাইডলাইন মোতাবেক ইনসাফের (সততা, ন্যায়বিচার) সাথে লিড করতে হবে। সবার সাথে পরামর্শ করা, সবার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা – এগুলো লিডারের দায়িত্ব। তারপর সে যে সিদ্ধান্ত নিবে, সেটি বেশিরভাগের পছন্দ হতেও পারে, নাও হতে পারে। লিডারশীপ একটি দায়িত্ব, তাকে তার সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে আখিরাতে। আর বাকিদের দায়িত্ব হলো লিডারের কথা মানা। তবে কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কিছু করতে বললে লিডারের কথা মানা যাবে না।
এর পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ ও মাজলুম ব্যক্তিকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে সে হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগ করে) তা প্রতিহত করবে। যদি তা না পারো তবে কথা দিয়ে প্রতিহত করবে, তাও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটিই ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’ (সহীহ মুসলিম, ৭৪)
আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো; সে জালিম হোক বা মাজলুম। আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মাজলুমকে সাহায্য করব তা তো বুঝলাম কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করব?’ তিনি বললেন, ‘তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে।’ (সহীহ বুখারি, ২৪৪৪)