ফেলটুস থেকে টপার (৪র্থ পর্ব)

ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলাম। এরপর কী যে হলো, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। একের-পর-এক রেজাল্ট খারাপ হতে থাকল। ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় তিনটা সাবজেক্টে ফেইলই করে বসলাম। বাবা বলল আমাকে অটো কিনে দেবে… আর পড়াশোনা করাবে না। মা আমার পিঠে ঝাড়ু ভাঙ্গার আর পাশের বাড়ির মেহেদীর পা ধোয়া পানি খাওয়ানোর ইচ্ছা পোষণ করল। এ সময় আমার জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে হাজির হলো ফুপাতো ভাই হাসান। আমাকে বেশ কিছু টিপস দিল সে। সেই টিপস ফলো করে এর পরের পরীক্ষাগুলোতে একের-পর-এক ছক্কা হাঁকাতে থাকলাম আমি।

সেই টিপসগুলোই তোমাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার করছি আমি। আগের পর্বগুলো না পড়ে থাকলে পড়ে নাও দ্রুত। 

আমার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবার একটা কারণ ছিল পরীক্ষার সময় আমি একেবারে অকূল সাগরে পড়তাম। কী কী পড়ব, কই থেকে পড়ব কিছুই আমার ঠিক করা থাকত না। ক্লাস করতাম না ঠিকমতো,  ক্লাসে নোট নেওয়া তো বিলাসিতা! বন্ধুদের কাছে পরীক্ষার আগের রাতে গেলে একেকজন একেকরকমের আচরণ করত- ভালো ভালো গোলুমুলুরা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত, পরীক্ষার আগের রাতে আমি ওদের সময় নষ্ট করছি! আর পাজি ছেলেগুলো নোট দেবার বিনিময়ে বিরিয়ানি খেতে চাইত, এত টাকা আমি কই পাই!  

ছোটাছুটি, দুশ্চিন্তায় পরীক্ষার মধ্যে আমার তেমন কোনো পড়াই হতো না। হাসান ভাই আমাকে বললেন তোর এই স্বভাবটা বদলানো লাগবে। যদি এই একটা স্বভাব বদলাতে পারিস, ক্লাসে ঠিকঠাক নোট নিতে পারিস, তাহলেই কেল্লাফতে! ক্লাসের নোট নেওয়া আর নোটবুক গুছিয়ে রাখা হলো সেই সিক্রেট ওয়েপন, যা তোর পড়াশোনাকে অন্য লেভেলে নিয়ে যাবে। এরপর সে আমাকে নোট নেওয়া নিয়ে অনেকগুলো টিপস দিল। সেগুলো শেয়ার করব আজ তোমাদের সাথে।

আমার মতো তোমাদের অনেকের মাথাতেই হয়তো এই প্রশ্ন এসেছে, নোট নেওয়ার দরকার কী? পরে ইউটিউবে বা গুগলে দেখে নিলেই তো হবে! বা বন্ধুদের কারও কাছ থেকে নিলেই তো হবে।

নোট নিলে দেখবা ক্লাসের জটিল জটিল টপিকগুলাও তুমি বুঝতে পারছ। আর পড়া ভুলে যাবার সমস্যা তোমার অনেকখানি দূর হয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোনো কিছু শুধু শোনার চাইতে শোনার পাশাপাশি লিখে ফেললে, সেগুলো মানুষ বেশিদিন মনে রাখতে পারে।

নোট হলো তোমার ব্যক্তিগত পড়ার প্লেলিস্ট। এগুলো শুধু তোমার জন্য বানানো, সবকিছুর মূল পয়েন্ট হাইলাইট করা থাকে। একটু চোখ বুলালেই মেইন মেইন পয়েন্টগুলো তোমার মাথায় গেঁথে যাবে। আগে যেখানে ৫ ঘণ্টা পড়া লাগত, এখন ২ ঘণ্টা পড়লেই হবে।

সবকিছু যেহেতু একজায়গায় গোছানো থাকবে, পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করা একেবারে পানি হয়ে যাবে। আর রিভিশন দিতে পারবা কয়েকবার। নোট ছাড়া তুমি হয়তো খাতা বা বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাবে, অথবা বন্ধুকে বারবার জিজ্ঞেস করবে- দোস্ত এটা কী, ওইটা কী! কিন্তু তোমার আতেল বন্ধু যে সে সময় তোমাকে হেল্প না করে ব্লক করে দেবে না তার কী গ্যারান্টি!

ধাপ ১: দ্যা আর্ট অফ নোট নেওয়া (হাত ব্যথা না করেও)

প্রস্তুত হও, প্রোদের মতো!

  • ক্লাসে যাওয়ার সময় খাতা, কলম আর হালকা কিছু খাবার সঙ্গে রাখো (১/২ টা খেজুর হতে পারে)।
  • স্যার যদি আগে থেকে বলে দেন কোন টপিক পড়াবেন, তাহলে ক্লাসে যাবার আগে সেটা একটু দেখে যাও। এটা ব্রেইনকে প্রি-লোড করার মতো।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লিখো

  • সবকিছু লেখার দরকার নেই। তুমি তো সাংবাদিক নও! বরং, কীওয়ার্ড, সংজ্ঞা আর স্যার যা যা বারবার বলছেন সেগুলো লিখো।
  • স্যার মাঝে মাঝে বোর্ডে লিখেন, এগুলো সব খাতায় টুকে নাও।

ঘিচিমিচি নয়, সুন্দর করে লিখো

  • ঘিচিমিচি করে লিখলে পরে কিন্তু আর বুঝতে পারবে না কী লিখেছিলা। স্পষ্ট, পরিষ্কার করে লিখো, ফাঁকা জায়গা রাখো।
  • সুন্দর করে লিখতে গেলে স্যারের সাথে তাল মেলানো যাবে না এমন মনে হলে শব্দ ছোট ছোট করে লিখতে পারো। যেমন- সাপ্র- মানে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া। আমা মানে হলো কবি আল মাহমুদ।

ক্লাসে মনোযোগ দাও, প্রশ্ন করো

  • বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় খুব মনোযোগী থাকো না? এমন থাকো।
  • কোনো কোনো স্যারের ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে রাখা একটু কষ্টকর মনে হতে পারে। কষ্ট হলেও খিচ মেরে বেঞ্চে বসে থাকো।
  • কোনো কিছু না বুঝলে স্যারকে প্রশ্ন করো, সেই প্রশ্নের উত্তর বা অন্যদের প্রশ্নের উত্তরে স্যার কী বলেন সেগুলো নোটে লিখে নাও।

ধাপ ২: নোটবুকের (হালাল!) মেকআপ

গুছিয়ে রাখো

প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা নোটবুক রাখো। সবকিছু এক জায়গায় লিখলে পরীক্ষার আগে কোনো টপিক খুঁজতে গেলে তোমার হালুয়া টাইট হয়ে যাবে।

সূচিপত্র তৈরি করো

নোটের শুরুর ১/২ টা পৃষ্ঠাতে সুন্দর করে টেবিল করো। এখানে লিখো এই নোটের কত পৃষ্ঠায় কোন কোন চ্যাপ্টার আছে। এই কাজ পরীক্ষার আগে তোমার অনেক সময় বাঁচিয়ে দেবে।

তারিখ আর শিরোনাম দাও

প্রতিটি নোটের শুরুতে তারিখ আর টাইটেল দাও। এটা নোট থেকে কোনো কিছু খুঁজে বের করা বা পরীক্ষার আগে রিভিশনের সময় খুবই কাজে লাগবে।

যেমন, ‘১৮/১১/২৪ – চেতনা ব্যবসা!’

কালার কোডিং করো

হাইলাইটার দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রং দিয়ে ক্যাটাগরি তৈরি করো। বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দাগিয়ে রাখো। যেমন- সংজ্ঞার ক্ষেত্রে নীল রং, উদাহরণ হলুদ, পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লাল। পরীক্ষার আগে রিভিশন দেবার কাজ আরও আরামসে হবে।

প্রয়োজনীয় পেজ চিহ্নিত করো

স্টিকি নোট ব্যবহার করো, ফর্মুলা বা গুরুত্বপূর্ণ পেজ মার্ক করার জন্য। খাতার সাইজ অনেক বড় হলে প্রতিটি চ্যাপ্টার কোথায় থেকে শুরু হয়েছে তা বোঝার জন্য সেখানে কাগজের টুকরা বা স্টিকি নোট দিয়ে রাখতে পারো।

ধাপ ৩: নিয়মিত চোখ বুলাও (নজরের হিফাযত করতে হবে না!)

নোট নিয়ে দারুণ কাজ করলা, কিন্তু সেগুলোতে যদি নিয়মিত চোখ না বুলাও তাহলে তো উপকার পাবা না, চাঁদু!

  • প্রতিদিন: প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও চোখ বুলাও।
  • প্রতি সপ্তাহে: পুরো সপ্তাহের নোট ১৫ মিনিট ধরে রিভিউ করো। এটা কনসেপ্ট মনে রাখতে খুবই খুবই সাহায্য করবে।
  • পরীক্ষার আগে: পরীক্ষার আগে নোট পড়ে তামা তামা করে ফেলাও!

যা করা যাবে না:

  • তোমার নোটকে ইনস্টাগ্রামের বুলেট জার্নালের মতো সুন্দর বানানোর দরকার নেই। মোটামুটি চলনসই হলেই হবে। নোটবুকে ডিজাইন করা, রং করতে গিয়ে পড়ার সময় বের করতে পারছ না, এমন যেন না হয়।
  • প্রথমে একটু কষ্ট হলেও, দাঁত চেপে নোট নিয়ে যাও। ক্লাস মিস দিয়ো না, ধারাবাহিকভাবে নোট নাও। হাল ছেড়ো না।

ভাইয়া,আপু! তুমি যদি একটু মনোযোগ দাও ক্লাসে, নোট করো আর দিনের জাস্ট ৫ মিনিট সময় নোটের উপর চোখ বুলাও, ক্লাসের কোনো পড়াই তুমি আর ভুলবা না ইনশাআল্লাহ। জাস্ট ৫ মিনিট। চিন্তা করে দেখো, পরীক্ষার আগে তাহলে তোমার কত সুন্দর একটা প্রস্তুতি হয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে। কিছুদিন ট্রাই করে দেখো। ফলাফল না পেলে আমি ১ ঘণ্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকব! প্রমিস!

(চলবে ইনশাআল্লাহ…)

[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]


by

Tags: