প্রথম পর্ব পড়ে নাও এখান থেকে।
পরদিন রাতে;
এশার সালাত আদায় করে বাসায় ফিরছে দুজনে। বাসার কাছে একজায়গায় এসে ওয়াহিদ দাঁড়িয়ে গেল। চারিদিকটা কেমন থমথম করছে, নিস্তব্ধতা ঘিরে ফেলেছে পুরো এলাকাকে। গা ছমছমে একটা ব্যাপার কাজ করছে।
– এখানে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন হঠাৎ?
– তোর ভূতটাকে দেখাবো তাই দাঁড়ালাম।
– ওয়াহিদ, ফাজলামো করবি না বলছি, এসব নিয়ে মশকরা একদম ভালো লাগে না।
– আল্লাহ আছেন তো! ভয় কীসের?
রবিনের হাত ধরে দরজায় ঠকঠক শব্দ করে সামনের বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়ল ওয়াহিদ।
বেশ পুরোনো ছোট একটা বাড়ি। অযত্নে পড়ে আছে অনেকদিন, তা চারদিকে দেখলেই বোঝা যায়। দরজা দিয়ে ঢুকেই যে ঘরটি, সেখানে কম আলোর একটি বাল্ব জ্বলছে। ঘরের এককোণে ছোট একটা পুরোনো টেবিল রাখা, তার ওপর কয়টা মলিন রঙিন কাগজ।
ঘরের মেঝেতে বসে ছিলেন একজন বৃদ্ধা। মোটা ফ্রেমের ঘোলাটে কাঁচওয়ালা চশমাটা আঁচল দিয়ে মুছে চোখে এঁটে ওয়াহিদের দিকে তাকালেন তিনি।
– আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ, দাদিমা।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। তুই আইছিস বাপ, তোর বন্ধুরেও সাথে আনছিস, আয় এদিকে আয়।
ময়লা একটা মাদুর পেতে রবিন আর ওয়াহিদকে বসিয়ে দিলেন বৃদ্ধা। কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, ‘তোরা বস, ভাই। আমি একটু খাবারের ব্যবস্থা করি।’
ওয়াহিদ বাধা দিয়ে বলল, ‘আহ দাদিমা, ওসবের প্রয়োজন নেই।’
তার কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁপা স্বরে বললেন, ‘চুপ কর তুই, প্রয়োজন নাই কে বলছে?’
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে হেঁটে ভেতরের দিকে চলে গেলেন। রবিন এতক্ষণ সবকিছু চুপ করে দেখছিল। সুযোগ পেয়ে সে মুখ খুলল।
– ব্যাপার কী? ঐ বুড়ি দাদিকে তুই চিনলি কীভাবে?
– আরে অপেক্ষা কর, বাড়িতে গিয়ে তারপর সব বলব ইনশাআল্লাহ।
এক বাটি মুড়ি নিয়ে ফিরে এলেন বুড়ি।
– এই গরিবের বাড়িতে আইছিস তোরা। তোদের একটু ভালো করে আদর-যত্নও করতে পারছি না।
– আরে দাদিমা, এভাবে বলছো কেন? মহান আল্লাহ যখন যা দিচ্ছেন, তাতেই আমরা খুশি, আলহামদুলিল্লাহ! তাই না রবিন?
– হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ!
দুজনেই তৃপ্তিকরে বুড়ির মুড়িমাখা খাচ্ছে। আর এই দৃশ্য দেখে আনন্দে বুড়ির মন ভরে যাচ্ছে।
মুড়ি হাতে তুলে নিতে নিতে ওয়াহিদ বলল, ‘দাদিমা, আমরা একাই খাচ্ছি; এটাতো ঠিক না। সবারই খাওয়া উচিৎ।’
বুড়ি বিস্ফোরিত নয়নে ওয়াহিদের মুখের দিকে তাকালো! ওয়াহিদ শুধু মৃদু হাসলো আর মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বুঝালো। বুড়ি সুবোধ বালিকার মতো উঠে কোণের একটা ঘরের দিকে চলে গেলে। কিছুক্ষণ পরেই বুড়ি ফিরল এক কিশোরকে নিয়ে। ওকে দেখে রবিন চমকে উঠল। যেন সামনে অর্ধমানববৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে! গাছের যেমন ছাল-বাকল থাকে, হাত-পাগুলো তেমন। আঙুলগুলো দেখে মনে হয় শাখা-প্রশাখায় ছত্রাক জন্মেছে! ওয়াহিদ রবিনের কানের পাশে গিয়ে আস্তে করে বলল, ‘রবিন, ভয় পাস না। ও হচ্ছে দাদিমার নাতি রাসেল৷’
– আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ, রাসেল! কেমন আছো?
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ ওয়াহিদ ভাইয়া, তুমি কেমন আছো?
– আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। রাসেল, এই যে ইনি তোমার রবিন ভাই। চিনতে পারছো?
রাসেল মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। ওয়াহিদ রবিনকে বলল, ‘আসলে এ-ক’দিন যাকে তুই দেখেছিস, সে হচ্ছে রাসেল। রাসেলই বাসার সামনে গিয়েছিল সে রাতে।’
রবিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্ত তুমি বাসার সামনে গিয়ে উঁকি কেন দিচ্ছিলে?’
রাসেলের চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমতে শুরু করেছে। গাল বেয়ে অশ্রুবিন্দুগুলো অসার হাতের ওপর গিয়ে টুপটাপ করে পড়ছে।
– দু’বছর আগেও আমি তোমাদের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলাম। কিন্তু…
কথা বলতে বলতেই থমকে গেল রাসেল। কথাগুলো দলা পাকিয়ে আটকে গেছে গলার কাছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।
– হঠাৎ সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল! এক সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে এই অবস্থায় আবিষ্কার করলাম! আমার পুরো দুনিয়া যেন আঁধারে ঢেকে গেল। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। কান্না করতে করতে আল্লাহকে বলেছিলাম, আল্লাহ আমার এ কী পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
– তুমি যখন বিকেলে বারান্দায় বসে থাকো, আমি তোমাকে জানালা দিয়ে দেখি। তুমি একা বসে বই পড়ো, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোমার কাছে যাই, কিন্ত…
– কিন্তু কী?
– কী করে যাই বলো, ভাইয়া? আগে যখন রাস্তায় বের হতাম, মানুষ আমাকে দেখে ভয় পেত, ঘেন্না করত, অনেকে ইট-পাথর যা পেত তাই দিয়েই মারতে আসত। ‘ভূত’, ‘জানোয়ার’, ‘দৈত্য’ আরও কত নামে ডাকত রাস্তায় দেখলে! তাছাড়া রোদে যেতেও খুব কষ্ট হয় আমার।
সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে ওর কথাগুলো শুনে। সকলের চোখই ভেজা। আজ মানুষের ভেতর থেকে মানবতা হারিয়ে গেছে।
– আচ্ছা ভাইয়া, বলো তো, এই রোগ কি আমি ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছি? না নিজে তৈরি করেছি? সবার ওই কটু কথা, বাজে দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্ব্যবহার; আর সহ্য করতে পারছি না! জানো ভাইয়া? কখনো মনে হয়েছে নিজেকে শেষ করে ফেলি, এত যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। কিন্ত পরক্ষণেই মনে পড়ে আত্মহত্যা যে মহাপাপ! ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার কষ্ট সইতে না পেরে নিজেকে হত্যা করে আমার চিরস্থায়ী দুনিয়ায় শাস্তির ব্যবস্থা কেন করব? আল্লাহ হয়তো আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এ পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে, এই কথাগুলো ভেবে নিজেকে সামলে নিই আমি।
ভরসায় পরিপূর্ণ কণ্ঠে রবিন বলল, ‘ঠিক বলেছ, রাসেল। তুমি এতটুকু ছেলে হয়েও কত সুন্দর চিন্তা তোমার! আর আমরা বড়রাও তোমার মতো করে হয়তো ভাবতে পারতাম না।’
রাসেল নিঃশব্দে মাথা নাড়ল শুধু।
– প্রায় একবছর হলো দিনের বেলায় আর বাইরে বের হই না। আর বাইরে যেতে খুব ইচ্ছে করলে রাতের বেলায় একটু বের হই। তবুও…। জানো রবিন ভাইয়া? তোমাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। দাদিকে পাঠিয়ে বেশ কয়েকবার তোমার খোঁজখবরও নিয়েছি। সেদিন রাতে ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করব। তাই তোমার বাসার সামনে গিয়েছিলাম; তবে বাসার ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। বাসার দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন দেখলাম তুমি চিৎকার করছিলে, যদিও হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয় তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করে যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে থেকে। আ-আসলে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, যদি লোকজন জড়ো হয়ে যায় আর আমাকে মারে!
ওয়াহিদ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। তারপর কী হয়েছিল।’
রবিন চোখের পানি মুছতে মুছতে রাসেলের দিকে তাকালো। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে রাসেলের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ওর মাথায় স্নেহমাখা পরশ দিলো রবিন। অনেকদিন পর যেন কেউ তাকে এত ভালোবেসে দেখছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
– কিন্তু এমন হলো কেন? কী হয়েছে রাসেলের? ও হঠাৎ এমন হয়ে গেল কেন? দাদি জিজ্ঞাসা করল। তিনিও রাসেলের এমন অবস্থার কারণ জানেন না।
– রাসেল ‘Tree Man disease’ বা বৃক্ষমানব রোগে আক্রান্ত।
তিনজনই ওয়াহিদের মুখের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিকে চেয়ে আছে। এসব কী বলছে ওয়াহিদ? এমন অদ্ভুত কথা কেউ শোনেনি আগে। কী অদ্ভুত নাম! বৃক্ষমানব!
ওয়াহিদ বলল, ‘ইভি-তে আক্রান্ত হওয়ার ফলেই রাসেলের হাত ও পা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে এবং অনেকটাই গাছের মতো হয়ে গেছে।’[1]
*
রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে দুই বন্ধু গল্প করছিল। রাজিয়া বেগমও ওদের সাথে যোগ দিলেন। রবিন ওয়াহিদকে জিজ্ঞেস করল, সে এসব বুঝল কীভাবে? বুড়ি দাদির নাতির এই অসুখ এসব কীভাবে জানল ওয়াহিদ? ওয়াহিদ রহস্যময় একটা হাসি দিলো।
– আরে ওয়াহিদ, বল না?
– গতকাল বাইরে একা একা ঘুরছিলাম, মনে আছে তোর?
– হু।
– তখন বাজার থেকে ফেরার সময় দেখলাম বুড়ি দাদিমা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন। হাঁটতে পারছেন না ব্যাগ নিয়ে। তাই আমি উনার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। তখনই উনার সাথে পরিচয়। আজ দিনের বেলায়ও উনার বাড়িতেই গিয়েছিলাম৷ তখনই ওকে দেখেছি।
রবিনের মা রাসেলের কথা শুনে খুব কষ্ট পেলেন। উনার চোখও ভিজে গেল, উনি চোখ মুছে রাসেলের জন্য দুআ করলেন।
‘তবে আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে কোনটা জানেন, আন্টি? মানুষের এই নির্মম আচরণের কথা শুনে। সবারই উচিৎ অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো। অসুস্থদের খোঁজ নেওয়া।’
– ঠিক বলেছিস। জানো মা? আমরা রাসেলকে বলেছি যে, যখন ওর ইচ্ছে করবে তখনই আমাদের বাসায় চলে আসতে।
– খুব ভালো করেছিস, বাবা। আল্লাহ তোদের নেক কাজগুলোর জন্য উত্তম প্রতিদান দেবেন ইনশাআল্লাহ।
—
পরদিন সকালে…
মুখ কালো করে রাজিয়া বেগম ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার মলিন চেহারা ওয়াহিদকে বড্ড কষ্ট দেয়।
– আজকেই কেন চলে যেতে হবে, বাবা? আর ক’টা দিন থেকে গেলে হতো না?
– না, আন্টি। কদিন তো ছিলামই।
ঢলে পড়া সূয্যিমামার সাথে এগিয়ে চলেছে ওয়াহিদ। রবিন ও রাজিয়া বেগম স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তার দিকে। হঠাৎ রবিনের কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল। পেছন ফিরতেই চমকে উঠে সে!
[1] এপিডার্মো ডিসপ্লেশিয়া ভেরুকোফরমিস (ইভি), বৃক্ষমানব নামেও পরিচিত একটি বিরল জন্মগত বংশবাহিত চর্মরোগ। একে চিহ্নিত করা হয় ত্বকে হিউম্যান প্যাপিলোম্যাভাইরাসেস (এইচপিভি) এর অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা হিসাবে। —উইকিপিডিয়া
[ষোলো সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত]
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.