‘ভাই, সারাদিন অনেক পড়ি। কিন্তু কিছুই মনে থাকে না। খালি ভুলে যাই। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই খারাপ’—এমন অভিযোগ তোমাদের অনেকেরই। আজকের এই লেখায় আমি মূলত দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ১২টি কৌশল নিয়ে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আলোচনা করব। আশা করি, এগুলো প্র্যাকটিস করলে তোমার স্মৃতিশক্তি আগের চেয়ে স্মার্ট ও দীর্ঘস্থায়ী হবে ইনশাআল্লাহ।
১. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো : স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, প্রতিনিয়ত গুনাহে লিপ্ত থাকা। গুনাহ হলো অন্ধকার, আর জ্ঞান হলো আলো। অন্ধকার ও আলো কখনো একসাথে থাকতে পারে না। ইমাম শাফিয়ি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি (আমার শাইখ) ওয়াকীকে আমার খারাপ স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলাম; তিনি শিখিয়েছিলেন আমি যেন গুনাহ থেকে নিজেকে দূরে রাখি। তিনি বলেন, “জ্ঞান হলো একটি নূর; আর আল্লাহর নূর কোনো পাপচারীকে দেওয়া হয় না।”’
এক ব্যক্তি মালিক ইবনু আনাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হে আব্দুল্লাহ, আমার স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে দিতে পারে এমন কোনো কিছু কি আছে?’ তিনি বলেন, ‘যদি কোনো কিছু স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে, তা হলো গুনাহ ছেড়ে দেওয়া।’
যখন কেউ কোনো গুনাহে লিপ্ত হয়, এটা তাকে উদ্বেগ ও দুঃখের দিকে ধাবিত করে। সে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় এবং জ্ঞানার্জনের মতো কল্যাণকর বিষয় থেকে সে দূরে সরে পড়ে। তাই তোমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। ইনশাআল্লাহ, পরিবর্তনটা নিজেই দেখতে পারবে।
২. নিয়মিত ব্যায়াম করো : ব্যায়াম করলে যেমন পেশী বাড়ে, তেমনি মস্তিষ্কের আকারও বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্কে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অক্সিজেন ও গ্লুকোজ সরবরাহ বাড়ে। এ জন্যই পড়া মুখস্থ না হলে অনেক সময় অনেকে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে। তখন সহজেই সেটি মনে থাকে।
প্রতিদিন সকালে বা বিকেলে অল্প সময় হলেও ব্যায়াম করার চেষ্টা করবে। খোলা জায়গায় ব্যায়াম করতে পারলে ভালো। তাতে তুমি ভিটামিন ডি–ও পাবে। ব্যায়াম করা নিয়ে পড়তে পারো এই লেখাটি – ঘাম ঝরানোর দিনে।
৩. পুষ্টিকর খাবার খাও : পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যক। তাই মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাবার খাবে। যেমন : যয়তুনের তেল, মধু, বাদাম, কিশমিশ, কুমড়া বীজ। টমেটো, পালং শাক, ডিম, দুধ, মাখন, মাছের তেলও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে এমন খাবার বেশি খাওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন : ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল। বেশি বেশি পানি পান করবে। চিনি ও চিনি জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম খাবে। যেমন : কোল্ড ড্রিংকস। সিংগারা, সামুচার মতো ভাজাপোড়া না খাওয়ার চেষ্টা করবে।
৪. দুঃশ্চিন্তামুক্ত থাকো : কোনো কাজে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা। যেই মস্তিষ্কে দুঃশ্চিন্তা বাসা বাঁধে, সেটা একপ্রকার অকার্যকর হয়ে পড়ে। মনে দুঃশ্চিন্তা থাকলে কোনো কাজেই মন বসে না। কোনো কাজই ঠিকভাবে করা যায় না। তাই মনের ঘর থেকে সকল দুঃশ্চিন্তা দূর করে তারপর পড়তে বসবে।
৫. পরিমিত বিশ্রাম নাও : প্রতিদিন দেহের প্রয়োজন পরিমাণ না ঘুমালে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। কারণ, ঘুমের ঘাটতি থাকলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। সারাদিন কাজের ফলে আমাদের শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম তোমার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে৷ রাত জেগে ফোন চাপাচাপি করবে না। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়বে। পরীক্ষা কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগের রাতে অবশ্যই ভালোভাবে ঘুমিয়ে নেবে।
প্রতিদিন দুপুরেও অল্প সময় ঘুমিয়ে নিতে পারো। এটা তোমার মন-মেজাজ ও অনুভূতিকে চাঙা রাখবে। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্নাহও বটে।
৬. অন্যদের সাথে আলোচনা করো : তুমি যা শিখবে তা তোমার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করো। মেয়েরা বান্ধবীদের সাথে আলোচনা করবে। কোনো কিছু শেখার একটি উত্তম ও কার্যকরী উপায় এটি। কেননা, এর জন্য তোমাকে একই বিষয় বারবার ও বিভিন্ন উৎস থেকে পড়তে হবে। এতে করে ঐ বিষয়টি তোমার স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে গেঁথে যাবে ইনশাআল্লাহ।
৭. বই পড়ার অভ্যাস করো : প্রতিদিন বই পড়ার ফলেও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কেননা, বই পড়ার সময় ধৈর্য সহকারে পড়তে হয় ও প্রতিটি লাইন বুঝে বুঝে পড়তে হয়। যাদের একদমই বই পড়ার অভ্যাস নেই, তারা হয়তো শুরুতে বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু প্রতিদিন বই পড়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বই পড়ার অভ্যাস আয়ত্তে আনতে পারবে। পড়ার জন্য সবসময় উপকারী বইকে প্রাধান্য দেবে।
৮. কুরআন তিলাওয়াত শুনো : কুরআন তিলাওয়াতের সুর আমাদের মস্তিষ্ককে দ্রুত সক্রিয় করে তোলে। কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময় যদি কারও মস্তিষ্কের ছবি তোলা যায়, তাহলে দেখা যাবে পুরো মস্তিষ্ক তিলাওয়াতের প্রভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া মস্তিষ্ক কুরআন তিলাওয়াতের নির্মল স্মৃতি দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে। এটা স্মৃতিভ্রংশের মতো মানসিক অবস্থা ঠেকাতেও বেশ কার্যকর। তাই প্রতিদিন রুটিন করে কিছুটা সময় কুরআন তিলাওয়াত শুনবে।
৯. স্ক্রিন-আসক্তি থেকে দূরে থাকো : স্ক্রিন-আসক্তি বা অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। আর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এছাড়াও স্ক্রিন-আসক্তির কারণে নানা ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার থেকে দূরে থাকবে।
১০. বদভ্যাস থেকে দূরে থাকো : কোনো বদভ্যাস (যেমন : ধূমপান, মদপান বা গোপন পাপের অভ্যাস) থাকলে, তা বাদ দাও। এই ধরনের বদভ্যাস মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। তাই এগুলো থেকে দূরে থাকবে। আর যারা এ ধরনের বদভ্যাসে জড়িত তাদের থেকেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবে।
১১. মাঝেমধ্যে রুটিন বদলাও : অনেকদিন একই রুটিনে থাকতে থাকতে ব্রেইন অনেক সময় ঠিকঠাক কাজ করে না। তাই জীবনযাত্রায় মাঝেমধ্যে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসা উচিত। ছুটির দিনে পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে পারো। ভ্রমণ বা নতুন স্থানে ঘুরে বেড়ালে ব্রেইন একটু সতেজ হয়, স্মৃতিশক্তি ভালো হয়। এছাড়া নতুন কোনো ভাষা শেখা, রান্নাবান্না করা, বাগান করা ইত্যাদি যেকোনো কাজ করতে পারো। কারণ, নতুন কোনো কাজ করার সময় আমাদের ব্রেইন অনেক বেশি সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠে। ফলে ব্রেইন স্মৃতিতে যেকোনো কিছুই খুব সহজে ধরে রাখতে পারে।
১২. আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও : তুমি যতই চেষ্টা করো না কেন, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করতে পারবে না। তাই সবসময় আল্লাহর কাছে দুআ করবে, যেন তিনি তোমার স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেন এবং উপকারী জ্ঞানার্জনকে তোমার জন্য সহজ করে দেন। এক্ষেত্রে নিচের দুআটি পড়তে পারো,
رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
অর্থ : হে আমার পালনকর্তা, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন। [সূরা ত্ব-হা : ১১৪]
দারুণ ব্যাপার কি জানো? এই দুআটি আল্লাহ তাআলা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাহলে বুঝতেই পারছ, এই দুআর গুরুত্ব কত বেশি।
তাছাড়া আল্লাহর যিকির করলেও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
‘…যখন ভুলে যাও, তখন তোমার পালনকর্তাকে স্মরণ করো…’ [সূরা আল-কাহ্ফ : ২৪]
তাই তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করবে। একটু অবসর পেলেই তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ইত্যাদি পড়বে।
এই ছিল বারোটি টিপস। আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগুলো মেনে চলবে। তাহলে দেখবে, তোমার ভুলে যাওয়ার সমস্যা অবশ্যই অবশ্যই কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর তোমার সমস্যা দূর হয়ে গেলে, আমার জন্য দুআ করতে ভুলো না যেন!
[ষোলো ৬ষ্ঠ (মে-জুলাই ২০২৪) সংখ্যায় প্রকাশিত।]