সেন্টমার্টিনের অজানা ইতিহাস (১ম পর্ব)

আমাদের মাঝিবা ও হুমায়ুন আহমেদ!

নব্বইয়ের দশক। হুমায়ুন আহমেদ তখন তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। উপন্যাস কিংবা নাটক তার সবই ভিন্ন একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করে। তার কিছু উপন্যাসের কারণেই মূলত সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটনের দুয়ার খুলে যায়। হুমায়ুন আহমেদের সেন্টমার্টিনে একটা বাড়ি আছে। নাম ‘সমুদ্র বিলাস’! ১৯৯২ সালে বাড়িটি বানিয়েছিলেন তিনি।

নব্বইয়ের মাঝামাঝি শীত মৌসুমে হুমায়ুন আহমেদ একবার তার বাড়িতে আসেন। সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০-৫০ জন ছাত্র। তখন সেন্টমার্টিনে কোনো জেটি ছিল না। মানুষজন ট্রলার থেকে এক বা দুই টাকা দিয়ে কুলির কাঁধে চড়ে উঠানামা করত।

তার সাথে আসা টিমের অনেক মালামাল ছিল। একটা ৫০ জনের পিকনিক করার যা যা প্রয়োজন সবই এনেছে তারা। তখন মালামাল বহনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঠেলাগাড়ি। লেবার দিয়ে মালামাল নামিয়ে ঠেলা গাড়িতে উঠাচ্ছিল তারা। খাসি, চাউল, লাকড়ি, তেল, মসলা, হাড়ি পাতিল ইত্যাদি। নামাতে নামাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। হঠাৎ লেবাররা সন্দেহজনক কিছু বস্তা নিয়ে আপত্তি তোলে। এগুলো তারা নামাতে অস্বীকৃতি জানায়।

ঘাটে থাকা ছাত্রদের চাপে পড়ে লেবাররা ঐ বস্তাগুলো ট্রলার থেকে ঠেলাগাড়িতে তোলে। আর খবরটা বড় মসজিদে পাঠিয়ে দেয়। মাঝিবা মাগরিবের নামাজের পর মুসল্লিদের বিষয়টি অবহিত করেন। ফলে পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। এলাকার মুরব্বি ও সমাজ কমিটি জরুরি বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ঐ ঠেলাগাড়ি তল্লাশি করা হবে।

মাঝিবার পরিচয় তো তোমাদের দেওয়া হয়নি মনে হয়। মাঝিবার আসল নাম মৌলভি আব্দুর রহিম (রহিমাহুল্লাহ)। তিনি ছিলেন একজন আল্লাহর ওলি, দ্বীনদার আলিম ও সমাজ সংস্কারক। উনাকে সবাই মাঝিবা (মেজো আব্বা) বলে ডাকত। দ্বীপের সাধারণ মানুষ পাপ বা অন্যায় করার আগে আল্লাহর ভয়ের পরে মাঝিবাকে ভয় পেত। মাদক, ব্যভিচার, জুলুম, যিনা, তালাক, পরকীয়া, চুরি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখার মতো সক্রিয় ছিলেন আমাদের মাঝিবা।

ছাত্রদের বাধায় বড় মসজিদের সামনে ঠেলাগাড়ি তল্লাশি সম্ভব হয়নি। তারা মুরব্বিদের সাথে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে এক প্রকার জোর করে ঠেলাগাড়ি নিয়ে চলে যায়।

খবরটা নিমেষেই পুরো দ্বীপে জানাজানি হয়ে যায়। দ্বীপবাসী ঢলের মতো মসজিদে আসতে থাকে। ঠেলাগাড়িটি ওয়াপদা পার হয়ে লাইটহাউজ পর্যন্ত পোঁছায়। ততক্ষণে জনতার মিছিল ঠেলাগাড়িকে ধাওয়া শুরু করেছে।

ছাত্ররা প্রথমে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও পরে দ্বীপবাসীর বিক্ষুব্ধ অবস্থা দেখে যে যার মতো পালিয়ে যায়। আশেপাশের ঘরবাড়িগুলো ছাত্রদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। মহিলারা তাদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয় যাতে ক্ষুব্ধ কেউ ছাত্রদের মারতে না পারে। দ্বীপের সৌন্দর্য এটাই, এক পক্ষ ক্ষুব্ধ হলে, তাদের মধ্যেই আরেকপক্ষ মমতার চাদর বিছিয়ে দেয়!

সমুদ্র বিলাসে এ খবর পৌঁছার সাথে সাথে হুমায়ুন আহমেদ সমুদ্র বিলাসে থাকা ছাত্রদের দ্রুত মানুষের ঘরে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ তিনি জানতেন দ্বীপের মহিলারা অনেক মানবিক ও শান্ত স্বভাবের। স্যার নিজে উত্তর বিচ দিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে চলে আসেন এবং ঢাকায় যোগাযোগ করেন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ফাঁড়িতে কল দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেন।

কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ ও দারোগা সাহেব জানেন ফাঁড়ির পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সব সদস্য মিলিয়েও ক্ষুব্ধ দ্বীপবাসীর সামনে কিচ্ছু করতে পারবে না। হুমায়ুন স্যার ও ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলোচনা করলেন দ্বীপের সবার সাথে কথা বলা সম্ভব না। চেয়ারম্যান মেম্বার দিয়েও কাজ হবে না। বরং দ্বীপের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা আব্দুর রহিম আলীর সাথে কথা বলতে হবে।

এশার নামাজের পর মাঝিবা, পুলিশ কর্মকর্তা ও হুমায়ুন আহমেদ একসাথে বসে এ সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।

একপ্রকার আপস রফা হয়। যা হবার সকালে হবে। দ্বীপের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে যা প্রয়োজন সবই করার প্রতিশ্রুতি দেন ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও হুমায়ুন আহমেদ।

রাতে মসজিদের মাইকে এলান হলো, সকালে বিচার হবে। রাতে যেন কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের না মারে বা ক্ষতি না করে। ছাত্ররা যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা যেন তাদের নিরাপত্তা দেয়।

সকাল হলো। বাজারে এক শালিসি বৈঠক শুরু হলো। মাঝিবা, অন্যান্য ময়-মুরুব্বি, পুলিশ, হুমায়ুন আহমেদ সবাই বসলেন।

দ্বীপের মানুষ বৈঠক স্থলে থইথই করছে। কী সিদ্ধান্ত আসে সেটা নিয়ে চরম কৌতুহল সবার।

সন্দেহজনক বস্তাগুলো খোলা হলো। সব গুলো মদ! মদের বোতলের চ্যাং চ্যাং শব্দ এলাকাবাসীর কানে যেতেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো। দ্বীপে মাদক নিষিদ্ধ। দ্বীপের কেউ মদ খায় না, ব্যবসাও করে না। এমনকি এ মদের সাথে তারা কখনো পরিচিতও না! প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে সবাই হা করে দেখছে মদের বোতলগুলো। তখন দ্বীপে মাদক বলতে কয়েকজন গোপনে গাজা সেবন করে সেটাই। তারাও এক প্রকার জনবিচ্ছিন্ন ছিল।

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘দ্বীপের মানুষকে ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য। দেশের আইন ও দ্বীপের রক্ষণশীল সমাজের ভাবাবেগে আঘাত লাগে এমন কোনো কাজ পুলিশ হতে দেবে না ইনশাআল্লাহ!’

হুমায়ুন আহমেদ বললেন, ‘আমি এ দ্বীপের বাসিন্দা! দ্বীপের মানুষকে ভালোবাসি বলেই আমি এখানে বাড়ি করেছি। আমার অবসর এখানে কাটে। দ্বীপের সহজ-সরল ও ধার্মিক মানুষদের আমি অনেক ভালোবাসি। এ রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থাকে আমি সম্মান করি। তাঁদের আবেগে আঘাত করাকে আমি চরম অপছন্দ করি। কিন্তু কী আর করব, আমার অজান্তে আমার ছেলেরা এমন একটা কাজ করছে আমি নিজেও লজ্জায় পড়ে গেলাম। দ্বীপবাসীর কাছে আমি আমার ছেলেদের হয়ে ক্ষমা চাইছি। আপনাদের পবিত্র দ্বীপটি অপবিত্র করতে চাওয়া চরম অন্যায়ের কাজ করেছে। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়। কিন্তু আপনারা আমার দিকে চেয়ে ক্ষমা করে দিন। আপনাদেরই সন্তান তারা! না বুঝে করছে!’

মাঝিবা পুরো দ্বীপের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ফলে হুমায়ুন আহমেদ মাঝিবার কাছেই ছাত্রদের হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

মাঝিবা বললেন, ‘ভুল মানুষেরই হয়। আমরা দ্বীপের মানুষ সবসময়ই মানবিক ও দয়াবান। দ্বীপে যদি কোনো পাপ হয় তাহলে দ্বীপ ডুবে যাবে। তাই আমরা পাপ করতে দিই না। আমরা জলে ভাসা একটা ছোট ডিঙ্গির ওপর বসবাস করি। তাই সবসময় ভয়ে থাকি যেন আল্লাহর গজব না আসে। ওরা ছোট মানুষ, ভুল করেছে। আমরাও মাফ করে দিচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন যেন না হয়, আপনি খেয়াল রাখবেন।’

মাঝিবাকে উদ্দেশ্য করে সেদিন হুমায়ুন আহমেদ বলছিলেন, ‘আমার জীবনে অনেক নেতা ও মুরুব্বি দেখেছি। আপনার মতো দেখিনি। দ্বীপের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—সকলেই আপনাকে সম্মান করে। এরকম সর্বজনীন সম্মানিত ব্যক্তি আমি আগে দেখিনি। আপনাকে দেখলে নিজে থেকেই সম্মান চলে আসে!’

প্রশাসন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রশাসনের বাহিরে এমন কিছু মানুষ থাকা দরকার, যাদের দ্বারা আইন ও সমাজের কল্যাণ হয়।

আমার এখনো মনে আছে। সেদিন সকলের উপস্তিতিতে মদের বোতলগুলো ভেঙ্গে ঝুড়িতে করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আর উপস্থিত অনেকেই সেদিন মদের গন্ধে বমি করেছিল। কেউ কেউ মদ ভাঙ্গার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বলে বাড়িতে এসে গোসল করে পবিত্র হয়েছিলেন। অথচ আজ পবিত্র এ দ্বীপে ঘরে ঘরে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবী! এখন মাদকের টাকা দিয়ে কুরবানি দেয়, তাবলীগে যায়, মসজিদে দান করে! সুন্দর সুন্দর বয়ান করে! নির্লজ্জ!

(চলবে ইনশা আল্লাহ…)


Posted

in

by

Tags: