উত্তরের অপেক্ষায়

কথা হচ্ছিল বন্ধু সোহানের সাথে। প্রেম নিয়ে বই লিখছি জেনে একটু কৌতুহলী হলো।[1]

গুল মারিস না। তুই হুজুর হইয়া বই লিখবি প্রেম নিয়া? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল সে।

বিস্তারিত শোনার পর বলল– বাহ চমৎকার! শোন তবে, তোকে আমার একটা ঘটনা বলি।

প্রায় পনেরো বছর আগের ঘটনা। আগুন ঝরা চৈত্রের দিন। সেদিন আমার মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।[2] এত্ত আনন্দ এত্ত আনন্দ!

বয়সটাই মনে রঙ লাগার। চোখে রঙিন চশমা। সেই রঙিন চশমা দিয়ে সবকিছুই ভালো লাগে। রবি ঠাকুরের ভাষায় ‘ফুলের বনে যারেই দেখি তারেই লাগে ভালো’। কালো চোখের এক বালিকাকে একটু বেশি ভালো লেগে গেল। আড়ালে আবডালে থেকে চুরি করে বালিকাকে দেখি। বাম বুকে সুখের মতো ব্যাথা লাগে। বালিকাও মাঝে মাঝে চেরা চাহনি হানে আমার দিকে। মনে হয় বুকের মধ্যে কে যেন ছুরি মেরে দিল। উফফফ! কী অসহ্য সুন্দর সেই দিনগুলা।

সেইদিন বালিকা আমার দিকে সোজাসুজি অনেকক্ষণ চেয়ে ছিল। সেই বিশেষ কথাটি বলব বলব করেও বলা আর হয়ে উঠল না। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ এই খুশিতেই আমি ধরাশয়ী!

অঙ্কে ঘাপলা হতে লাগল, ক্লাসে মন থাকত না। শুধু সেই বালিকার অতলান্ত কালো দু’চোখ আমার ঘোলা চোখের সামনে ভাসত। আকাশে, বাতাসে, জলে ডাঙ্গায়, অন্তরীক্ষে শুধু সেই বালিকার কালো দু’চোখ।

মসজিদে নিয়মিত হয়ে গেলাম। নামাজ পড়া আর কীসের কী, শুধু দুআ করা! ইয়া আল্লাহ, বালিকার সঙ্গে আমার ‘ইয়ে’টা ঘটিয়ে দাও আল্লাহ। আমি একেবারে ভালো হয়ে যাব আল্লাহ। একেবারে। আর নামাজ মিস দিব না, মায়ের কথা শুনব। আল্লাহ, ‘ইয়ে’ টা ঘটিয়ে দাও আল্লাহ!

কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে উত্তর পেলাম না। আরও অনেক কারণে জল আর বেশিদূর গড়াল না। আমিও ভুলে যেতে থাকলাম সেই বালিকাকে। একেবারে নয় যদিও। বয়ঃসন্ধিকালের সেই মোহের কথা মনে হলে মাঝেমাঝেই একটু ইমোশনাল হয়ে যেতাম।

হেমন্তের আগুনঝরা রুপালী নক্ষত্রের রাত যখন আসত, যখন পরিযায়ী পাখিরা ডানা মেলত আকাশে চাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অথবা যখন গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুরের এক মহাদেশ নীরবতা ভঙ্গ করে বাবলা বনে অবিরাম আর্তনাদ করত নিঃসঙ্গ একটা ঘুঘু পাখি, বালিকার রাঙ্গা রাজকন্যার মতো মুখটা মনে পড়ে যেত। বুকের অনেক ভেতরে বহু কষ্টে চাপা দেওয়া সেই কালো চোখ দুটো চেরা চোখে তাকিয়ে থাকত যেন আমার দিকে। দুস্থ হৃদয় খুঁড়ে এক এক করে বেদনাগুলো জাগিয়ে দিত।

কিছুটা অভিমান হতো আল্লাহর ওপর। কেন আল্লাহ আমার সঙ্গে এমন করল? প্রেমটা হয়ে গেলে ভালোই তো হতো। আমার সঙ্গেই কেন আল্লাহ এমন করল? কী এমন পাপ করেছিলাম আমি? এত ডাকলাম আল্লাহর কাছে, এত করে চাইলাম… আল্লাহকে ডাকলে নাকি আল্লাহ সাড়া দেন। তাহলে আল্লাহ কেন আমার ডাকে সাড়া দিল না? বালিকার সাথে প্রেম হয়ে গেলে কতই না সুখে থাকতাম!

এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থেমে গেল সোহান। ওর মুখের অভিব্যাক্তি দেখে ও কী ভাবছে তা বুঝতে পারলাম না। আমিও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পর সে-ই নীরবতা ভাঙলো।

‘…প্রাক্তনের সাথে কুড়ি বছর পর দেখা হলে কী হতো তা জানতে চেয়েছিল জীবন বাবু। পৃথিবীর পথে হারিয়ে যাওয়া বালিকাকে আর একটিবার দেখার ইচ্ছা ছিল আমারও। জীবন বাবুর ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল কিনা বলতে পারি না। তবে আমি একদিন ঠিকই পেয়ে গেলাম তার দেখা। বিদায়ী হেমন্তের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার সন্ধিক্ষণে। ৯ বছর ৫ মাস পর। এবং এর ঠিক ২ সেকেন্ডের মাথায় এতবছর ধরে আল্লাহর প্রতি বয়ে বেড়ানো অভিমান দূর হয়ে গেল। তার সেই স্বপ্নের রাজকন্যার উগ্র পোশাক-আশাক, তথাকথিত সুশীল প্রগতিশীল আচার-আচরণ, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষজনের সামনে হাসতে হাসতে একটা ছেলের গায়ে হেলে পড়া, ছেলেদের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলা[3] সবকিছুই প্রবলভাবে নাড়া দিল আমাকে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে অভিমান ভরা বুকে জমা হলো অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ।

আল্লাহ যে বালিকার সঙ্গে ‘ইয়ে’টা ঘটিয়ে দেননি সে কারণে ইচ্ছে করল শহরের সব রিকশার পেছনে, সব লোকাল বাসের পেছনে, ‘এখানে পোস্টার মারলে জুতার বাড়ি ফ্রি’ লেখা সব দেয়াল, সমস্ত বিলবোর্ড… সবখানে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লিখে ভরিয়ে দিই।

আল্লাহর ওপর অভিমান করা, তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে ভীষণভাবে লজ্জিত হলাম।

সেই বালিকার সাথে প্রেম হয়ে গেলে কী করুণ হাল যে হতো আমার, কী মাইনাকার চিপায় যে ফেঁসে যেতাম, সেটা তো আর তখন বুঝতাম না। দুআ কবুল হচ্ছে না দেখে অবুঝের মতো অভিমান করতাম, আল্লাহর সিদ্ধান্তে মন খারাপ করতাম। কিন্তু আল্লাহ, আমার রব, আমার মালিক তো জানতেন কোনটা আমার জন্য ভালো। তাই তিনি আমার জন্য ভালোটাই বেছে দিয়েছিলেন। সকল প্রশংসা আমার রবের, সাত আসমানের মালিকের, যিনি কোনোরকম স্তম্ভ ছাড়াই সেগুলো উঁচু করে রেখেছেন।’

থেমে গেল সোহান হঠাৎ করেই।

ঠিক আছে রে, আজকে আসি। বলে হনহন করে চলে গেল সে। তবে আমি এর মধ্যেই দেখে ফেলেছি, তার চোখের কোণায় বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমেছে। কৃতজ্ঞতার।

[1] ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ বই লেখার জন্য অনেকের সাথেই প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কথা বলতে হয়েছে।

[2] সত্য ঘটনা। [3] সেই মেয়ের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে আরও অনেক কিছু বলল সোহান। সেগুলো তোমাদের জানার দরকার নেই। সোহান ছোটবেলায় বিশেষ করে স্কুলে থাকতে একটু অন্যরকম ছিল। তাই তখন সেই বালিকাকে ভালো লেগেছিল। ভার্সিটি শেষ করার পর চেইঞ্জ হয়। এখন একেবারে প্র্যাক্টিসিং না হলেও মনমানসিকতা ভালো। চেষ্টা করে ইসলাম পালন করার। এ কারণে সেই মেয়ের স্বভাব চরিত্র, পোশাক-আশাক দেখে ভুল বুঝতে পারল।


by

Tags: