ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ভালো স্টুডেন্ট হিসেবেই পরিচিতি ছিল আমার। ক্লাস এইটে উপজেলা সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিল। অনেকগুলো প্রাইভেট পড়া, একগাদা গাইড-নোটবুকে টেবিল ছিল ভরা। সকাল ৭ টায় আমার প্রাইভেট পড়া শুরু হতো। ২ টা প্রাইভেট পড়ে স্কুলে যেতাম। এরপর স্কুল শেষে আরও ২ টা। সারাদিন ছুটোছুটি করে বাড়িতে এসে আর পড়তে বসতে ইচ্ছে করত না। সারাদিন পর টায়ার্ড হয়ে যেতাম। একটু রিফ্রেশ হবার জন্য ফোন হাতে নিলে কোনদিক দিয়ে সময় চলে যেত খেয়ালই থাকত না। টিকটক আর ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে ফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লাম। পড়তে বসতেই ইচ্ছা করত না। আব্বুর ভয়ে পড়তে বসলেও মন শুধু ছটফট করত। পড়ায় একেবারে মনোযোগ দিতে পারতাম না। লুকিয়ে ফোন ব্যবহার করতাম। আবার ভালোভাবে পড়লেও দ্রুত ভুলে যেতাম। পরীক্ষায় জানা বিষয় ভুল করে আসতাম। যার জন্য হয়তো রেজাল্টের এই অবস্থা হতো।
একদিন আম্মু বলল, আমার পেছনে অযথা টাকা খরচ করে আর লাভ নেই। আব্বু সায় জানিয়ে বলল– আমাকে অটো কিনে দেবে। ভালো স্টুডেন্ট থেকে এভাবে ব্যাকবেঞ্চার হয়ে গেলাম। ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় ৩ টা সাবজেক্টে ফেলই করলাম! রেজাল্ট কার্ড নিয়ে বাসায় যাচ্ছি আর ভাবছি আজকে আমার খবর আছে। সেদিন আসলেই আমার খবর হয়ে যেত। তবে খবর হলো না; কারণ আমাদের বাসায় সেদিন বেড়াতে আসলো ফুপাতো ভাই হাসান। আল্লাহর খাস রহমত হিসেবে।
সব শুনেটুনে হাসান ভাই আমাকে পড়াশোনার বেশ কিছু টিপস দিল। সেই টিপস ফলো করে এর পরের পরীক্ষাগুলোতে একের পর এক ছক্কা হাঁকাতে থাকলাম আমি। সেই টিপসগুলোই তোমাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার করব আমি। যেন আর কারও বাবা কারও পিঠে চেয়ার ভাঙ্গার সুযোগ না পায়!
ফোনের নেশা কাটিয়ে স্মার্ট স্টুডেন্টদের মতো পড়াশোনা করবে কীভাবে?
- ফোন সাইলেন্ট অথবা Do Not Disturb মুডে রাখবে।
- পড়া শেষ হবার আগ পর্যন্ত ফোন অন্য ঘরে বা এমন জায়গায় রাখবে যেখানে ফোনের নাগাল পাওয়া কষ্টকর হবে।
- ৪৫ মিনিটের একটা এলার্ম দিয়ে রাখো। যতই যা হোক, এর মধ্যে তুমি একবারের জন্যেও ফোন হাতে নেবে না। দিন দিন সময় বৃদ্ধি করবে। প্রথমে ৪৫ মিনিট এরপর ৬০ মিনিট এভাবে।
- যে অ্যাপগুলো বেশি সময় নষ্ট করে সেগুলো ডিলিট করে দাও। যেমন- কোনো গেইমিং অ্যাপ, টিকটক বা মেসেঞ্জার অ্যাপ। অ্যাপের পরিবর্তে সরাসরি ব্রাউজার এর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করো। এতে ফোনের প্রতি টান কিছুটা কমবে।
- পড়তে বসার সময় বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দাও, ফোন ব্যবহার নয় পড়াশোনা করাটাই তোমার প্রধান লক্ষ্য।
- নো-ফোন জোন তৈরি করো। বাসার নির্দিষ্ট কিছু স্থানে যেমন- পড়ার টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বাথরুম, বিছানায় ফোন ব্যবহার করবে না।
- সব সময় ফোন নিয়ে ঘোরা বন্ধ করো। বাইরে খেলতে গেলে ফোন বাসায় রেখে যাও। প্রয়োজনে নরমাল এনালগ ফোন ব্যবহার করো।
- পড়ার সময় ফোন আম্মু/আপু বা ভাইয়ার কাছে জমা দিয়ে রাখো। বলে দাও, পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন তোমাকে ফোন না দেয়।
- যদি ফোন ব্যবহার একেবারেই কমাতে না পারো তাহলে ফোকাস ধরে রাখা, ফোন আসক্তি কাটানোর জন্য সহায়ক অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- Stay Free, Your Hour, Digital Detox, Stay Focused, Digitox, Social Fever ইত্যাদি।
স্মার্টভাবে পড়াশোনা করার ১২ টি টিপস
১। পর্যাপ্ত আলোর অভাবে প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। রুমের সাধারণ লাইটের পাশাপাশি টেবিল ল্যাম্প ব্যবহার করতে পারো। পাশাপাশি সূর্যের আলো আসে এমন স্থানে পড়তে বসো।
২। রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাও। কমপক্ষে ৭/৮ ঘণ্টা। বিশেষ করে পরীক্ষার আগের রাতে। মানুষ একটানা বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। ৪৫-৫০ মিনিট পর পর ১০/১৫ মিনিটের একটা ব্রেক নাও। ব্রেকে ফোন ব্যবহার না করে হালকা ব্যায়াম করো বা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকো। বা বাইরে থেকে ঘুরে আসো।
৩। একেবারে শেষ সময়ে পড়তে না বসে আগে থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দাও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রথমে পড়ে নাও। এরপর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
৪। বিভিন্ন রঙিন পেন্সিল/কলম/ মার্কার দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ো। এভাবে পড়লে দ্রুত আত্মস্থ করতে পারবে এবং বেশিদিন মনে থাকবে।
৫। কোল্ড ড্রিংকস, ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড মস্তিষ্কের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এসব খাবার এড়িয়ে চলবে। কলা, বাদাম, পালংশাক, মটরশুটি, ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন কমলালেবু, ডাল, সবুজ শাকসবজি, পর্যাপ্ত পানি রাখবে তোমার খাদ্য তালিকায়। এগুলো তোমার ব্রেইনকে শক্তিশালী করবে। পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
৬। পড়তে বসার সময় তোমার মনোযোগ নষ্ট করে দেয় এমন সবকিছু (যেমন ফোন) দূরে সরিয়ে রাখো। সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন বন্ধ করে দাও।
৭। মাঝে মাঝে (বিশেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে) চুপচাপ স্থির হয়ে বসে বা শুয়ে যা যা পড়লে তা মনে করার চেষ্টা করো। সেই টপিকগুলোর ওপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো। এরপর উত্তর দাও। এটি তথ্য মনে রাখার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী।
৮। এমনিতেই তোমার নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। তবে পড়ার চাপ বাড়লে ব্যায়াম করা কখনোই বাদ দেওয়া যাবে না। এটি তোমাকে সতেজ ও চনমনে রাখবে।
৯। পড়তে বসার পূর্বে কিছুক্ষণ কুরআন শুনে বা পড়ে নিতে পারো। এর ফলে বিভিন্ন চিন্তা তোমার মাথা থেকে দূর হয়ে মন স্থির হবে। পড়ায় দ্রুত মনোযোগ দিতে পারবে।
১০। পড়া শুরু করার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলবে এবং আল্লাহর কাছে দুআ করবে।
رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
বাংলা উচ্চারণ : রাব্বি যিদনি ইলমা
অর্থ : হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন। (সুরা ত্ব-হা, আয়াত : ১১৪)
১১। বেশি রাত জেগে পড়বে না। দ্রুত ঘুমিয়ে যাবে। ফজরের পর পড়াশোনার সবচেয়ে ভালো সময়। কয়েকদিন চেষ্টা করলেই ফজরের পর পড়ার অভ্যাস আয়ত্তে আনতে পারবে। প্রয়োজনে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবে।
১২। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লিখবে। এভাবে যেকোনো বিষয় তুমি খুব দ্রুত আত্মস্থ করতে পারবে।
স্মার্ট স্টুডেন্টদের মতো যেভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে :
পরীক্ষার…
- দুই সপ্তাহ বাকি
কীভাবে রিভিশন দেবে তা ঠিক করে নাও। অল্প অল্প করে পড়া শুরু করো। এখন ফাঁকিবাজি করলে শেষমুহূর্তে পাহাড়সমান পড়া জমে যাবে। পড়ার চাপে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে।
- এক সপ্তাহ বাকি
বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সলভ করো, মডেল টেস্ট দাও, তোমার বন্ধুদের প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করো, অন্যদের সাথে পরীক্ষার প্রস্তুতি, সাজেশন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করো।
- আগের রাতে
কলম, স্কেল, ক্যালকুলেটর, ঘড়ি, এডমিট কার্ড সব গুছিয়ে নাও। কীভাবে পরীক্ষার হলে যাবে তা ঠিক করে রাখো। রাত না জেগে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো। ৭/৮ ঘণ্টার একটা ঘুম দাও।
- সকালে
খুব ভালোমতো নাস্তা করো। নাস্তা না করলে পরীক্ষার হলে তোমার মাথা ঠিকমতো কাজ করবে না। পরীক্ষার হলে যাবার আগে দু রাকাত নামাজ পড়ে পরীক্ষায় সফলতার জন্য দুআ করো।
- ১ ঘণ্টা আগে
পরীক্ষার হলে চলে যাও। টেনশন না করে বন্ধুদের সাথে গল্প করো। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।
- ১ মিনিট আগে
আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। বিসমিল্লাহ বলে লেখা শুরু করো।
- পরীক্ষা শেষের ১ ঘণ্টা পরে
উত্তর মেলানোর দরকার নেই। ভালো/খারাপ যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই। বাসায় ফিরে বিশ্রাম নাও। পরের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নাও।
আজ এ পর্যন্তই। সামনের পর্বে ইনশাআল্লাহ আরও অনেক টিপস নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা হবে।