মৌমাছির জীবনচক্র

প্রকৃতি যে কত বৈচিত্র ধারণ করে রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এত বৈচিত্রের মধ্য থেকে কেন মৌমাছি নিয়ে কথা বলতে হবে? অবশ্যই এর কারণ আছে। সমগোত্রীয় অন্যান্য জীবের চেয়ে মৌমাছি আলাদা। এর রয়েছে বিশেষ কলোনি ব্যবস্থা, যেখানে রয়েছে নির্দিষ্ট আচার-ব্যবহার, বাচনভঙ্গি ও গোত্রভেদ। শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের অন্যতম এক নিদর্শন হলো মৌমাছির জীবনচক্র। পবিত্র কুরআনের সূরা নাহলে আল্লাহ তাআলা মৌমাছির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও মধুর গুণাগুণ সম্পর্কেও কুরআনে আয়াত এসেছে। মধু সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, কিন্তু মৌমাছির বিচিত্র জীবনচক্রের কথা অনেকেরই অজানা।

মৌমাছি সাধারণত গাছের উঁচু ডালে বাসা বানিয়ে থাকে। আগে ধারণা করা হতো, মৌমাচির একটি বাসা বা কলোনিতে দুই ধরনের মৌমাছি থাকে। পুরুষ মৌমাছি বাসা নির্মাণসহ সব ধরনের কাজ করে থাকে আর স্ত্রী মৌমাছিরা শুধু বাচ্চা উৎপাদন করে। কিন্তু এসব ধারণা পালটে যায় ১৯৭৩ সালের পর। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ভন-ফ্রিশ মৌমাছির জীবনযাপন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। নোবেলজয়ী এই গবেষক লক্ষ করেন, মৌমাছি আসলে দুই প্রকার না; বরং তিন প্রকার। পুরুষ, স্ত্রী এবং আরেক প্রকারের মৌমাছি যারা লিঙ্গভেদে মহিলা, কিন্তু প্রজননে অক্ষম। এদেরকে তিনি নাম দেন শ্রমিক মৌমাছি বা ‘Worker bee’। মূলত এই শ্রমিক মৌমাছিরাই যাবতীয় কাজ করে। অন্য দিকে স্ত্রী মৌমাছির কাজ সন্তান প্রসব করা। আর এ কাজে তাদের সাহায্য করে পুরুষ মৌমাছি। একটি বাসা বা কলোনিতে একটিমাত্র রানি থাকে। এক রাজ্যে যেমন একজন মাত্র রাজা থাকে এবং বাকিরা সবাই প্রজা হিসেবে তার আনুগত্য করে, ঠিক তেমনি সবাই রানি মৌমাছির আনুগত্য করে।

একমাত্র রানি মৌমাছিই ডিম পাড়ার ক্ষমতা রাখে৷ একটি রানি মৌমাছি দিনে প্রায় ২০০০ ডিম পাড়তে পারে। মৌচাকে ষড়ভূজাকৃতির ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ দেখা যায়, এর মধ্যেই মূলত রানি মৌমাছি ডিম পাড়ে। এই প্রকোষ্ঠগুলো পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে সকল কিছু করার দ্বায়িত্ব শ্রমিক মৌমাছিদের। রানি মৌমাছি তার ইচ্ছামতো প্রকোষ্ঠ বেছে নেয়। কোথাও বিন্দু পরিমাণ ময়লা থাকলে, সে সেখানে ডিম দেয় না। রানি মৌমাছি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের খোপগুলোতে নিষিক্ত ডিম এবং অপেক্ষাকৃত বড় আকারের খোপগুলোতে অনিষিক্ত ডিম পাড়ে। নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে কর্মী মৌমাছি হবে এবং অনিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে হবে ড্রোন অর্থাৎ পুরুষ মৌমাছি।

মৌচাকে মৌমাছিদের জীবনব্যবস্থাকে একটি মনুষ্য রাজতন্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়। এখানে প্রয়োজন অনুসারে প্রজাদের বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। একাধিক রানি যদি মৌচাকে বড় হতে থাকে, তবে সবার আগে যেটি পূর্ণাঙ্গ হবে, সেটি অন্যগুলোকে মেরে ফেলে নিজে রানি হবার আশায়। রানির যদি জীবনসংশয়ের ভয় থাকে, কর্মী মৌমাছিরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে হলেও তাকে রক্ষা করবে। এর উদাহরণ মেলে শীতকালে, রানির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য তাকে কর্মীরা ঘিরে ধরে একটা উষ্ণ আবরণের মতো তৈরি করে রাখে। একটি মৌচাকে রানি মৌমাছি হলো প্রজননযন্ত্র। কেননা এটিই একমাত্র ডিম পাড়তে সক্ষম উর্বর মৌমাছি। সাধারণত একটি রানি মৌমাছি সাত বছরের মতো বাঁচতে পারে। তবে কর্মীরা যদি প্রয়োজন মনে করে, রানিকে মেরে নতুন রানি নিয়োগ দিতে পারে। রানি মৌমাছি যদি ডিম পাড়তে অক্ষম হয়, কিংবা ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে আসে, সবকিছু বিবেচনাতে রেখেই কর্মীরা রানিকে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এখন আসি আরও মজার একটি বিষয়ে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে৷ এ জন্য তাদের কলোনি ছেড়ে দূরে যেতে হয়। মৌচাকের কর্মী মৌমাছিরা খাদ্য সংগ্রহ করে। সাধারণত মৌচাকে দুই ধরনের কর্মী মৌমাছি দেখা যায়। এরা হলো খাদ্য সন্ধানী কর্মী মৌমাছি বা স্কাউট এবং খাদ্য সংগ্রাহক কর্মী মৌমাছি বা ফোরেজার। খাদ্য সন্ধানী মৌমাছিরা কোথায় ফুলের মধু রয়েছে, তা সন্ধান করে। খাদ্যের সন্ধান পেলে এরা মৌচাকে ফিরে এসে বিশেষ ধরনের নাচের মাধ্যমে অন্য মৌমাছিদের সেই খাদ্যের উৎস সম্পর্কে তথ্য জানায়। এই নাচকে মৌনৃত্য বলে। মৌনৃত্যের সময় প্রতি সেকেন্ডের জন্য খাদ্য উৎসের দূরত্ব প্রায় ১০০০ মিটার হিসেবে তারা প্রকাশ করে। খাদ্যের সন্ধান পেলে কর্মী মৌমাছিরা মৌচাকের সামনে ইংরেজি ‘8’ অক্ষরের মতো একপ্রকার নাচ করে। বিজ্ঞানী কার্ল ফন ফ্রিশ সর্বপ্রথম মৌমাছি নৃত্যের অর্থ আবিষ্কার করেন। আর এর জন্যই তিনি 1973 সালে নোবেল পুরস্কার পান।

ফোরেজার মৌমাছিরা এরপর রানির অনুমতি নিয়ে সেই ফুলের কাছে পৌঁছায় এবং মধু সংগ্রহ শুরু করে। মধু সংগ্রহ করা শেষে তারা আবার কলোনিতে ফিরে আসে।

এখানেই শেষ নয়৷ তারা কলোনিতে ফিরে আসলে তাদের জন্য কিছু মৌমাছি অপেক্ষা করে। এদেরকে গার্ড মৌমাছি বলে। এরা মধুর শুদ্ধি পরীক্ষা করে দেখে৷ শুধু ভালো মানের মধু সংগ্রহ করা মৌমাছিকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়। বাকিদের সেখানেই মেরে ফেলে! কী নিষ্ঠুর, তাই না? অনেক সময় দেখা যায়, মৌচাকের নিচে কিছু মৌমাছি পরে থাকে; এটা তার অন্যতম কারণ।

একসময় রানি মৌমাছিটি বৃদ্ধ হয়ে ডিম পাড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন শ্রমিক মৌমাছিরা তাকে ঘিরে ধরে এবং অসংখ্য মৌমাছি মিলে একটি বলের মতো আকার তৈরি করে। এতে করে অসহনীয় তাপের কারণে রানি মৌমাছিটি মারা যায়। এরপর আবার নতুন রানি নির্বাচিত হয়। কী অদ্ভুত, তাই না?

তথ্যসূত্র :

১. Roar Media

২. Wikipedia (en)


by

Tags: