১.
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। হোস্টেলের ছাঁদে বসে সূর্যাস্ত দেখার অপেক্ষায় সিফাত। যদিও ঢাকা শহরের দানবাকৃতির এই বিল্ডিংগুলোর ফাঁকে সূর্যাস্ত দেখা যায় না। তারপরও অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ লালিমাটুকু বিল্ডিংয়ের মাথার ওপর এলোমেলো ছাতার ন্যায় জেঁকে বসেছে। কংক্রিটের এই প্রাণহীন শহরে সৌন্দর্য বলতে বুঝি এটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে।
তিন মাস হলো সিফাত হোস্টেলে উঠেছে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই ঢাকা চলে এসেছে। ভালো একটা কলেজে ভর্তি হবার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে হোস্টেলে উঠেছে। ফার্মগেইটের স্বনামধন্য একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তিও হয়েছে। কিন্তু সদ্য গ্রাম থেকে আসা বালক শহুরে পরিবেশের সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। এখানকার তুখোড় ছাত্রদের কাছে নিজেকে নাদান মনে হচ্ছে তার। হতাশার চোরাবালি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। আশার আলো বলতে যেটুকু আছে, তা হচ্ছে আগামীকালের রেজাল্ট। ভালো রেজাল্ট না আসলে বাবার কাছে মুখ দেখানোর আর কোনো উপায় থাকবে না।
সন্ধ্যার স্নিগ্ধ লালিমাটুকু আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে দানবাকৃতির বিল্ডিংগুলোর পেছনে। একদল কাক কা কা করে উড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই শহরে তারা আর কখনো ফিরবে না। সিফাতেরও নিজেকে মাঝে মাঝে এই কাকগুলোর মতো মনে হয়। যদি রেজাল্ট খারাপ হয়, তবে সিফাতও এই কাকগুলোর মতো শহর ছেড়ে চলে যাবে। আর ফিরবে না।
সিফাত যে বাজে ছাত্র, তা কিন্তু না। তবে কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার পর শহুরে ছাত্রদের দেখে তার মনোবল ভেঙে পড়েছে।
দূর আকাশে এখনো অখণ্ড লাল লাল মেঘ এলোমেলো পায়চারী করছে। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকাল সিফাত। ৬টা বেজে ৯ মিনিট। এরই মাঝে মাসজিদের শহর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেওয়া শুরু করেছে। সিফাত দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।
সন্ধ্যার পর বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলল সিফাত। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে এখন। মায়ের কথায় যেন জাদু আছে। মনের আকাশে জমা যাবতীয় বিষণ্ণতা সেই জাদুর বুলিতে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বাবাটা যেন কেমন তার! রসকষহীন কাঠখোট্টা এক লোক। তবে স্বভাবে গম্ভীর হলেও সিফাত জানে, তার কাঠখোট্টা চেহারাটার আড়ালে শুধু আর্দ্র ভালোবাসার নদী।
ফোনটা কেটে দিয়েছে বেশকিছুক্ষণ হলো। বাবা ফোন রাখার আগে বলেছে, ‘চিন্তা করিস না, রেজাল্ট ভালো হবে।’ বাবার এই আশাই সিফাতকে বারবার বিড়ম্বনায় ফেলে। যদি রেজাল্ট খারাপ হয়, তবে তো এই আশায় গুড়েবালি। বাবাকে তখন কী জবাব দেবে সে?
২.
ঘণ্টাখানেক হলো রেজাল্ট বেরিয়েছে। এই অবিশ্বাস্য রেজাল্ট দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে সিফাত। অসহ্য কান্নার দল অবিরত দলা পাকিয়ে আসছে গলার ভেতর। জীবনের এই চরম অপ্রিয় সত্যের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। গোল্ডেন এ+ না পেলেও সাধারণ এ+ তো কোনোভাবেই মিস হবার কথা ছিল না। তাই বলে ফেইল! তাও আবার রসায়নে!
অনেকক্ষণ যাবৎ মোবাইলে কেঁপে কেঁপে রিং হচ্ছে। নিশ্চয়ই আত্মীয়-স্বজনরা কল দিচ্ছে। বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিল সিফাত। বাবার সাথেও কথা বলার মুখ নেই তার। এই মুহূর্তে মরে যেতে পারলেই বোধহয় বাঁচা যাবে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। একটু পরেই পাশের রুম থেকে জিদান ভাই আসলো।
– কী রে, শুনলাম রেজাল্ট খারাপ হওয়াতে মন খারাপ করে আছিস?
বাম হাত দিয়ে বিধ্বস্ত চেহারাটা একটু মুছে নিল সিফাত। জগতের সমস্ত নিস্তব্ধতা যেন তার কণ্ঠকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই মুহূর্তে কান্না ছাড়া আর কিছুই বের হবে না। তারচেয়ে চুপ থাকাই ভালো। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সে।
– আরে, মন খারাপ করিস না। এটা নে; খেয়ে সপাং করে শুয়ে পড়। দুশ্চিন্তা কেটে যাবে!
কথাটা বলেই ছোট্ট একটা ট্যাবলেট সিফাতের পকেটে ঢুকিয়ে দিল জিদান ভাই। তারপর সিফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘জীবনটাকে এনজয় করতে শেখ, ব্যাটা।’ এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
জিদান ভাই রুম থেকে বেরুবার সাথে সাথেই একটা উৎকট পোড়া গন্ধ সিফাতের পেটের ভেতর ঢুকে গেল। এই পোড়া গন্ধটা আগেও কয়েকদিন তার শরীর থেকে পেয়েছে সে। প্রতিবারই সিফাতের বমি হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। সিফাতের রুমমেট রাসেল একদিন বলেছিল, সে যেন জিদান ভাইয়ের থেকে দূরে থাকে। কেন বলেছিল, সেটা অবশ্য সিফাত জানে। কিন্তু আজ এই লোকটাকে তার বড্ড আপন মনে হলো। মা-বাবার সাথে লজ্জায় কথা বলতে পারছে না সে। এই সময়ে এমন একটা ভরসার জায়গা সিফাতের খুব দরকার ছিল।
দ্রুত ট্যাবলেটের খোসাটা ছিঁড়ে এক ঢোকে গিলে ফেলল সিফাত। মনে মনে ভাবল, ‘একবার খেলে কিছুই হবে না’। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল তার চোখে।
৩.
সন্ধ্যা সাতটা। এক ঘুমেই চার ঘণ্টা শেষ। জিদান ভাইয়ের ডাকে কোনোমতে টেনেটুনে চোখদুটো মেলল সিফাত। উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে আসতেই জিদান ভাই বলে উঠল,
– লেটস গো, মাই বয়। চল, হেঁটে আসি।
সিফাত অমত করেনি। বিপদের সময় এই খারাপ লোকটাকেই তার পরম বন্ধু মনে হচ্ছে। তাই কিছু না বলেই উঠে পড়ল।
ঘণ্টাখানেক হেঁটেছে ওরা। দু’কাপ চা-ও খেয়েছে। হোস্টেলে ফেরার সময় সিফাতের দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে জিদান ভাই বলল,
– একটা সুখটান দে, ব্যাটা। দেখবি, দুঃখ-কষ্ট সব কোথায় বেরিয়ে যাবে!
– না, ভাই। আপনিই খান। আমি এসবের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
একটু নাক সিটকে উত্তর দিল সিফাত।
– আহারে, বাচ্চা ছেলেটা! তুই এখন বড় হয়ে গেছিস। এসব সামান্য ব্যাপারে এত মাথা ঘামালে চলে? একটা সুখটান দিয়েই দেখ। কথাটা বলে সিফাতের মুখের কাছে ধরল সিগারেটটা। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিগারেটটা হাতে নিল সে। তারপর ‘একবার খেলে কিছুই হবে না’ ভেবে আচমকা দিল একটান। অতঃপর বোকা মাছগুলোর মতো সে-ও বড়শিতে ধরা পড়ল।