আদবকেতা সিরিজ (১ম পর্ব)

লোকাল বাসে করে যাচ্ছি। একটা স্টপেজে ১০/১২ জন স্টুডেন্ট উঠল। প্রত্যেকের বয়সই ১৬/১৭ এর মতো হবে। দুপুরবেলা। অসময়। রাস্তাঘাটে তেমন ট্র্যাফিক নেই। বাসও খালি। বাসের মধ্যে আমরা সবাই ঝিমাচ্ছিলাম দুপুরের গরমে। ইউনিফর্ম পরা ওরা উঠামাত্রই নির্জীব বাসটা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। হই-হট্টগোলে ভরে উঠল বাস। একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিটে বসা বন্ধুদের কাছে ভাড়া আদায় করতে লাগল কন্ডাক্টর সেজে। আরেকজন নিল হেল্পারের ভূমিকা। সামনের স্টপেজগুলোর নাম ডাকছিল সে। ২/৩ জন নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে ক্লাসের কোন স্যার কী বলেছে এমন মজার মজার গল্প করছিল। বাকিরা খেলছিল এক সিট থেকে অন্য সিটে ছোটাছুটির মজার খেলা।

আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম। নিজের ওই বয়সটার কথা মনে হচ্ছিল। আহা, এই ভাবনাচিন্তাহীন বয়সটা যদি আবার ফেরত পেতাম। তবে চিৎকার চেঁচামেচিতে হালকা বিরক্তিও কাজ করছিল। আসলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুনিয়ার কুৎসিত কঠোর বাস্তবতায় হৃদয়ের স্বচ্ছ, নির্মল ছেলে মানুষটা মরে যাচ্ছে। ক্লেদাক্ত কলুষতা স্থান করে নিচ্ছে সেই স্থানে। বাসের অন্য যাত্রীরা সবাই আমার চাইতেও বড়। তারা আমার চাইতেও বেশি বিরক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। তাঁদের চোখেমুখেও বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছিল না।

এই কিছু না বলতে চাওয়াটাই আসলে আমাদের বড়দের সমস্যা। আমরা মুখ ফুটে কিছু বলি না। আদবকেতা শেখানোর চেষ্টা করি না। কিন্তু আবার পেছনে পেছনে ছোটদের বেয়াদব, উগ্র বলি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে জীবনমুখি শিক্ষা দিতে। স্কুল-কলেজও বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় আদব-কেতা শেখাতে পারে না বা শেখায় না। অনেক বড়রা ভাবেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে বেয়াদব, কিছু বলতে গেলে উলটো অপমানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই চুপ করেই থাকি। কিন্তু এভাবে দূরে সরিয়ে দিলে আমাদের ভাই-বোনেরা, আমাদের সন্তানেরা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে কীভাবে?

রাগারাগি না করে ধীরস্থির-শান্তভাবে ওদের বোঝালে ১০ জনের মধ্যে অন্তত ৫ জন বুঝবে। পথের প্রভুহীন কুকুরের মতো ছেড়ে না দিয়ে একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমাদের উচিত ওদের কাছে টেনে নেওয়া। এই চিন্তা থেকেই এই সিরিজটা শুরু করা। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, আশেপাশের আরও মানুষদের অভিজ্ঞতার মিশেলে এই লেখাটা লেখা হয়েছে। ভাইয়া ও আপুরা, তোমাদের হয়তো কোনো কোনো পয়েন্ট এখন মেনে নিতে কিছুটা কষ্ট হতে পারে। তবে আর ১০/১২ বছর পর যখন এগুলোর কথা ভাববে, আশা করি তখন আমাদের কিছুটা হলেও বুঝবে। আমরাও তোমাদের মতোই ছিলাম। আমাদেরও কষ্ট হতো বড় ভাই-বোন, বাবা-মা, স্কুল-কলেজের স্যার বা ক্রিকেট মাঠের ক্যাপ্টেন ভাইদের কথা মানতে। বিদ্রোহ করতে মন চাইত। অনেকে করতও।

কিছু আদবকেতা :

১। বাস বা যেকোনো গনপরিবহণে এমন আচরণ না করা, যেন পাশের যাত্রীদের কষ্ট হয়। বিশেষ করে বন্ধুরা সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুরতে গেলে। তোমাদের এই বয়সে স্বভাবসুলভ একটু অস্থিরতা, চঞ্চলতা থাকবেই। হই-হুল্লোড় করা দোষের কিছু না। তবে তা যেন অন্যদের বিরক্তির কারণ না হয়।

২। বাসে অসুস্থ, বয়স্ক, শিশু ও নারীদের জন্য সিট ছেড়ে দেওয়া। আমরা পুরুষ। আমাদের বৈশিষ্ট হলো শত কষ্ট হলেও অন্যদের আগলে রাখা। দুঃখ সয়ে নিয়ে হাসিমুখে অন্যদের সাপোর্ট করা।

৩। কেউ বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বললে, তা গোপন রাখা। অন্য কাউকে—সে যতই বিশ্বস্ত হোক না কেন—না বলা।

৪। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় যথাসম্ভব কম শব্দ করা।

৫। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করা।

৬। কাউকে অসময়ে (যেমন : সালাতের সময়, বিশ্রামের সময়, রাত ১০ টার পর ও সকাল ৯ টার আগে) একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফোন না করা। একবার ফোন করার পর ফোন না ধরলে আর ফোন না দেওয়া। প্রয়োজনে ম্যাসেজ দিয়ে রাখা।

৭। শুধু অনলাইনে পরিচিত, স্বল্প পরিচিত মানুষকে (সেলিব্রেটি, আলিম হলেও) একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান না করা। 

৮। অনলাইনে অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত, সেলিব্রেটি বা ব্যস্ত মানুষদের ইনবক্সে শুধু সালাম দিয়ে চুপ করে না থেকে প্রয়োজন বলে ফেলা। ম্যাসেজের রিপ্লাই পেতে দেরি হলে তাড়াহুড়া না করা। বিরূপ ধারণা পোষণ করবে না, ভাইয়া/আপু। উনারা প্রচুর ম্যাসেজ পান। উনারা যদি আমাদের সবার ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে যান, তাহলে লেখালেখি বা অন্য প্রোডাক্টিভ কাজ কখন করবেন, বলো?   

৯। হাই, হ্যালো করার জন্য ব্যস্ত মানুষদের অনলাইনে নক না দেওয়া।

১০। কারও ফোন, কম্পিউটার বা যেকোনো জিনিস ব্যবহারের আগে তার অনুমতি নিয়ে নেওয়া। ‘ভাই, চাবিটা দেন! একপাক ঘুরে আসি’ – এভাবে হুটহাট করে বাইক/সাইকেল ধার না চাওয়া। সম্পর্ক খুব ভালো, কাছের ভাই বেরাদর হলেও।

১১। টাকা ধার না করা। ধার করলে যথাসময়ে ফেরত দেওয়া। দিতে দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলে ধার নেবার সময়ই তা জানিয়ে রাখা। লেনদেনে দুইজন সাক্ষী রাখা। লিখিত দলিল রাখা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর খুব গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।

১২। বই ধার নিলে যথাসময়ে ফেরত দেওয়া।

১৩। রুমে প্রবেশের আগে নক করা, অনুমতি নেওয়া। খুব ভালো হয় সালাম দিতে পারলে।   

১৪। অন্য কারও রুমে প্রবেশের সময় বা বের হবার সময় দরজা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় রাখা। অর্থাৎ দরজা খোলা রাখলে খোলা রাখা। বন্ধ থাকলে বন্ধ করে যাওয়া। যত কম শব্দে পারা যায় দরজা বন্ধ করা।

১৫। পাবলিক প্লেইসে ভিডিও দেখতে হলে হেডফোন ব্যবহার করা, যাতে অন্যের কোনো সমস্যা না হয়।

১৬। টিকেট কাউন্টারসহ অন্যান্য স্থানে সিরিয়াল মেনে লাইনে দাঁড়ানো।

১৭। রিকশা নেবার আগে ভাড়া ঠিক করে নেওয়া।

১৮। সামনে বসে থাকা কোনো ব্যক্তির সাথে কথোপকথনের সময় ফোন ব্যবহার না করে তাকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া।

১৯। বন্ধুদের মধ্যে গুটিবাজি না করা (গীবত,কূটনামী ইত্যাদি)।

২০। লিফটে চুপ চাপ থাকা। হই-হট্টগোল বা ফোনে কথা না বলা। একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনো কথা না বলা। 

২১। লিফটে অন্যদের সাথে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখা। গা বা মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।

২২। লিফটে উঠার জন্য তাড়াহুড়া বা ঠেলাঠেলি না করা। ভদ্রভাবে শান্তশিষ্টভাবে সিরিয়াল মেনে লিফটে উঠা।

২৩। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার সময় সীমা বজায় রাখা। সে মন খারাপ করতে পারে এমন বিষয়ে মজা করা, পঁচানি দেওয়া – ইত্যাদি করা উচিত না। আবার কার সঙ্গে কতটুকু মজা করা যাবে এই সীমাটাও বোঝার চেষ্টা করা।

২৪। কোনো বন্ধুর কাছ থেকে জোর করে কোনো কিছু না খাওয়া বা ট্রিট আদায় না করা। হতে পারে তার আর্থিক সমস্যা চলছে। সে নিজের সম্মান বজায় রাখার জন্য অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করবে। তোমার বন্ধুকে তো তুমি কষ্ট দিতে চাও না, তাই না?

২৫। বই, সুগন্ধি ইত্যাদি যে-কারও কাছে গিফট না চাওয়া। এটাতে সেই ভাই/বোন মুখের ওপর কিছু না বললেও মনে মনে বিরক্ত হতে পারে। আর চেয়ে নিলে তো সেই জিনিস আর গিফট থাকে না, তাই না?

এই দেখো! দশটা পয়েন্ট লিখতে চেয়েছিলাম। পঁচিশটা হয়ে গেল। আজকে এ পর্যন্তই থাক। সামনে আরও বিষয় আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এই বিষয়গুলো নিজের জীবন থেকে ঠেকে শেখা। আশা করি তোমাদের কাজে লাগবে। ভালো থেকো। সুস্থ, সুন্দর, তরতাজা, সজীব হয়ে বেড়ে উঠো…

টা টা।


by

Tags: