এক.
টেলিভিশন বা মিডিয়া আসার আগের সময়টায় সেলিব্রেটিশিপ-এর ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে কাজ করতো আমার জানা নেই। যারা জনপ্রিয় বা তারকা ছিলেন তাদেরকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ বেশিরভাগ মানুষেরই হতো না। মানুষ হয়তো বিখ্যাত মানুষদের কথা না তাদের নাম “শুনেছে” কেবল, অথবা বড়জোর বইয়ের পাতায় পড়েছে, কিন্তু দেখেছে খুব কমই। যে কেউ চট করে বিখ্যাত হতে পারতো না, হলেও তার নামডাক এত ছড়াতো না, আর ছড়ালেও অতটা মাতামাতি ছিল না।
এরপর একটা সময় আসলো যখন টেলিভিশনের পর্দায় আমরা কিছু মানুষকে দেখতে শুরু করলাম। অল্প কিছু মানুষ, চেনা কিছু মুখ, ঘুরেফিরে তাদেরকেই দেখা যেত। তারা ছিল তারকা, আর আমরা বাকিরা হলাম দর্শক। তারকাদের দর্শন এর পরিসর বেড়ে গেলো বহুগুণে। তৈরি হলো একটা “পর্দা”, পর্দার ওপারে কিছু মানুষ দেখা দিলো, কথা বলল, অভিনয় করল, গান গাইল, নাচল– আর আমরা পর্দার এপার থেকে মুগ্ধ হতে লাগলাম। পর্দার ওপারের মানুষগুলোকে আমরা কখনো সামনাসামনি দেখিনি, কথা বলিনি, কাছ থেকে কখনও খোঁজ নিই নি, জানতে পারিনি মানুষগুলো আসলে ঠিক কেমন – কিন্তু তাদের প্রতি আমাদের ভালোলাগা, মুগ্ধতা আর কৌতূহল জড়ো হলো – যেমন করে আগুনের কাছে একরাশ উইপোকা জড়ো হয়।
কিন্তু খুব বেশিদিন পর্দার এপারে আর থাকা গেলো না। পর্দার ওপারের মানুষগুলোকে দেখতে এত ভালো লাগে, নিজেকে কেন সেখানে দেখা নয়? ইন্টারনেট নিয়ে আসলো নতুন একটা পর্দা – সোশাল মিডিয়া। স্যাটেলাইট টিভির মতো তার অনেকগুলো চ্যানেল – ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টুইটার, টিকটক। টেলিভিশনের পর্দায় “চান্স” পাওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু এই পর্দায় খুব সহজেই চাইলে নিজেকে দেখানো যায়, আর ভিউ পাওয়া যায় – শুধু কোনোরকমে একটা কন্টেন্ট বানাতে পারলেই হলো।
প্রশংসা পেতে সবারই ভালো লাগে। আর মানুষের এই স্বভাবজাত চাওয়ার এক বাঁধভাঙ্গা বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখছি এই যুগে। কমেডি, লিপসিঙ্ক, নাচ, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি, ঘুরতে গেলেই চেকইন, ট্রলভিডিও – এই সবকিছুর পেছনে মূল চাওয়া আমাদের একটাই – পর্দার এপারে পারফর্ম করে ওপারের মানুষদের কাছে আমরা প্রশংসা আর বাহবা চাই। বেশিরভাগের মানুষের আর কোনো উদ্দেশ্য এখানে থাকে না।
দুই.
মানুষের স্বভাব হচ্ছে সে মানিয়ে নেয়। কিছু একটা অভ্যাসে পরিণত হলে সেটাকে সে প্রশ্ন করে না। নতুন কিছু পেলে পুরোনোকে ভুলে যায়। অর্থহীন কাজ বারবার করতে থাকলে সেটাও একসময় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
সোশাল মিডিয়ায় ডুবে যাওয়ার পর আমরা শুধু হিসেব করেছি – কী পেয়েছি? এই হিসাব করি নি – কী হারিয়েছি। প্রথমেই আমরা যা হারিয়েছি, তা হলো “কাছের মানুষ”। সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে আমরা যাদেরকে চিনেছি, ভালোবেসেছি, যাদের জন্য পাগল হয়েছি – তাদের কতজনকে আমরা ঠিকমতো চিনি? তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তারা কেমন – সেটা কি আমরা জানি? মানুষগুলোকে যতটুকু চমৎকার দেখাচ্ছে, সে কি তার কাছের মানুষদের সাথে আরো ভালো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু আসলে উল্টোটা হয়। নারী অধিকারের হ্যাশট্যাগ দিয়ে ফেইসবুক ক্যাম্পেইন করা ছেলেটার চরিত্র খুব খারাপ, আর মেয়েটা ঘরে কাজের মেয়েকে পেটায়। দেশপ্রেমের ভান ধরা লোকটা একটা আস্ত ডাকাত অথবা হাজার মানুষের জন্য মোটিভেশনাল ভিডিও বানানো মানুষটা নিজ ঘরে বড় একা। যদি কাছ থেকে দেখা যেত, তাদের বেশিরভাগকেই মানুষ ঘৃণা করত।
অথবা, যদি এমন হয়, আমি নিজে একজন সেলিব্রেটি, প্রতিনিয়ত লাইক কুড়িয়ে ফিরছি – ভেবে দেখি, আমাকে যারা লাইক দিচ্ছে, বাহবা দিচ্ছে – তাদের ঠিক কয়জন আমার কাছের মানুষ? তারা আমাকে সত্যিকার অর্থে কী দিচ্ছে একটা ক্ষণিকের ভালোলাগার অনুভূতি ছাড়া? এই ক্ষণিকের ভালোলাগার অনুভূতি আসলে এক প্রকার মাদকের মতো। যেটা নিতে ভালো লাগে, কিন্তু জিনিসটা মোটেও ভালো কিছু না। সোশাল মিডিয়াতে আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করছি নিজের জীবন থেকে অনেকগুলো সময়কে খরচ করে – কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সামান্য ‘মজা পাওয়া’ ছাড়া কিছুই আর পাচ্ছি না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়ায় আমরা যাদের সাথে যোগাযোগ করি, তাদের সাথে আমাদের সত্যিকারের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে না, তারা আমাদের ‘কাছের মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভার্চুয়াল মানুষগুলোকে আমরা ভুলেও যাই। প্রয়োজনে, কষ্টে, বিপদে, একটুখানি অপছন্দ হলে – না আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, না তারা আমার পাশে দাঁড়াতে পারে। প্রচণ্ড ঠুনকো এই সম্পর্কের পেছনে এতটা সময় বিনিয়োগ করে লাভের খাতায় যা পাচ্ছি, হারাচ্ছি তার বহু গুণ– সময়, মানুষ, ভালোবাসার সম্পর্ক।
সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাওয়াগুলো বদলায়। ছোটবেলায় পছন্দের একটা খেলনা না পেলে একটা বাচ্চা যখন কাঁদে তখন মনে হয় যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। কৈশোরে ভর করে যতসব পাগলামি। যৌবন যখন দরজায় কড়া নাড়ে তখন প্রেম, বিনোদন আর কিছু একটা নিশ্চিত আয়ের পথ। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে একটা মানুষ যখন তার শেষ গন্তব্যের দিকে যেতে থাকে, ফেলে আসা জীবনের বেশিরভাগ জিনিসকেই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়, তার কাছে দামী হয়ে উঠে ‘কাছের মানুষ’রা, তাদের ভালোবাসা এবং আদর–যত্ন। আর দুনিয়াকে যখন সে বিদায় দেয় তখন তার কাছে থাকে কেবল দুটি সম্পদ – ঈমান এবং ভালো কাজ।
এই সোশাল মিডিয়া আমাদের দুনিয়া এবং দুনিয়ার পরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই চাওয়াগুলোকে কেড়ে নিচ্ছে। চাওয়া না বলে প্রয়োজন বলা ভালো। কাছের মানুষ ছাড়া দুনিয়াতে মানুষ অসহায়, ঈমান আর ভালো আমল ছাড়া আখিরাতে অসহায়। দিনের সবচেয়ে বেশি সময় আমরা যেটা করছি সেটা হচ্ছে স্রেফ শো-অফ, এমন কিছু মানুষকে দেখাচ্ছি, যারা আমাদের কার্যত কোনো কাজে আসে না। এমন কিছু মানুষকে ভালোবাসছি যারা চলনে-কথনে ভারি সুন্দর, কিন্তু যার অন্তরে কিছুই নেই।
আমাদের মধ্যে এমন আছে যারা সোশাল মিডিয়ার এই পর্দায় নিজেকে দেখিয়ে বেড়ানোর মত যথেষ্ট cool নয়। তারা অন্যের পাওয়া দেখে নিজের না-পাওয়ার হিসেব কষে অপ্রাপ্তির তালিকা তৈরি করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে পর্দার মানুষগুলোর ভেতরে কী আছে, তাদের না-পাওয়াটা আরো কত তীব্র।
তিন.
ভাই ও বোনেরা, পৃথিবীতে আমরা খুব অল্প একটা সময়ের জন্য এসেছি। যখন আমাদের রবের কাছে ফিরে যাবার সময় আসবে, তখন এই পৃথিবী যে কতটা তুচ্ছ, সেই বোধ আমাদের আসবে বা বলা চলে দুনিয়ার মোহভঙ্গ হবে। আল্লাহ তাআলা বারবার বলেছেন, দুনিয়ার জীবন ধোঁকা ছাড়া কিছুই নয়।
ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ওয়েডিং ফটোগ্রাফির পর্দায় নিজেকে দেখাতে বা অন্যকে দেখতে গিয়ে আমরা যা হারাব, তা কখনও ফিরে পাবার নয়। যাদের প্রশংসা কুড়াতে আমরা এতটা ব্যস্ত হচ্ছি, তারা এই জীবনেই আমাদের ভুলে যেতে এতটুকু সময় নেবে না। কাছের মানুষগুলো কিন্তু সহজে আমাদের ছেড়ে যায় না। তাদের জন্য আমাদের সময় কই?
‘পর্দা’য় একজনকে দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু পর্দায় ঠিক ততটুকুই দেখি যতটুকুতে কারো স্বার্থ আছে। এই পর্দাটাকে প্রয়োজনের বাহিরে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। এই পর্দা যদি আমার মন থেকে আল্লাহ তাআলাকে ভুলিয়ে দেয়, যদি দেখিনি এমন মানুষগুলোকে খুব গুরুত্ব দিতে শেখায়, তবে সেই পর্দাকে ছিঁড়ে ফেলি। একদিন চোখের পর্দা খুললে যেন কাঁদতে না হয়।