সেই মানুষটার গল্প বলি। হয়তবা আগে শুনেছ, তবুও আবার বলি। সেই দিনের কথা বলি যা এখনো আসেনি, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আসবে। সেই সময়টার কথা বলি, যা তুমি ভুলে গেছ। কিন্তু অবধারিতভাবে যা তোমাকে গ্রাস করবে।
পুনরুত্থানের দিন। জড়ো করা হয়েছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের। মানবজাতি অসহায়, সন্ত্রস্ত, অপেক্ষমান। চিন্তিত, অস্থির, অক্ষম। সেইদিন মানুষ তাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য আর্জি নিয়ে দুনিয়ার রাজাদের কাছে যাবে না। দুনিয়ার শাসকদের কাছে যাবে না। তারা ছুটে যাবে আল-আম্বিয়ার (নবিদের) কাছে – আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম।
মানুষ প্রথম ছুটে যাবে মানবজাতির পিতা আদমের কাছে, আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। তারা আদম আলাইহিস সালাম-এর কাছে গিয়ে বলবে-
‘হে আদম, আপনি কি মানুষের অবস্থা দেখছেন না? অথচ আল্লাহ আপনাকে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন। আপনাকে তিনি তাঁর ফেরেশতাগণ দিয়ে সিজদাহ করিয়েছেন। আর আপনাকে সব জিনিসের নাম শিখিয়েছেন। কাজেই আপনি আমাদের রবের কাছে সুপারিশ করুন, যেন এ স্থান থেকে আমাদেরকে তিনি স্বস্তি দেন।’
আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলবেন – এ কাজের জন্য আমি উপযুক্ত নই। আমাদের পিতা আদম নিজের ভুলের কথা স্মরণ করবেন এবং মানুষকে বলবেন মানবজাতির প্রতি প্রেরিত প্রথম রাসূল নূহ-এর কাছে যেতে, আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।
তারা নূহ আলাইহিস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনিও বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। তিনি তাঁর কৃত ভুলের কথা স্মরণ করবেন, এবং মানুষকে বলবেন আল্লাহর খলীল ইবরাহীমের কাছে যেতে, আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।
তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনিও তাদের কাছে স্বীয় ভুলের কথা উল্লেখ করে বলবেন- আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা বরং মূসার কাছে যাও। তিনি এমন এক বান্দা যাঁকে আল্লাহ তাওরাত দিয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলেছিলেন।
তারা তখন মূসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনিও বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের যোগ্য নই। তাদের কাছে তিনি নিজের ভুলের কথা উল্লেখ করবেন এবং বলবেন, তোমরা বরং ঈসার কাছে যাও। যিনি আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল, কালিমা ও রূহ। আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম।
তখন তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম-এর কাছে যাবে। তখন ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ ﷺ-এর কাছে যাও। তিনি এমন এক বান্দা, যার আগের ও পরের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে।
আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা – আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম। তাঁরা কেউ সুপারিশ করতে সাহস করবেন না। প্রত্যেক নবি নিজেদের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করবেন।
তারপর সবাই মুহাম্মাদ ﷺ-এর কাছে যাবে। তিনি তাঁর রবের কাছে অনুমতি চাইবেন এবং তাঁকে অনুমতি দেয়া হবে। তিনি তাঁর রবের সামনে সিজদাহবনত হবেন। আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি, বিচারদিনের মালিক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল যতক্ষণ ইচ্ছে করবেন ততক্ষণ মুহাম্মাদ ﷺ সেই অবস্থায় থাকবেন।
তারপর তাঁকে ﷺ বলা হবে,
‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠান। বলুন, শোনা হবে। চান, দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, গ্রহণ করা হবে।
মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রবের শিখিয়ে দেয়া প্রশংসার দ্বারা তাঁর প্রশংসা করবেন এবং বলবেন,
‘উম্মাতি, উম্মাতি
(আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ)’
সমগ্র মানবজাতি, এমনকি নবিগণ আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম নিজ নিজ অবস্থা নিয়ে সন্ত্রস্থ থাকবেন। সবাই নাফসি, নাফসি করতে থাকবেন। মুহাম্মাদ ﷺ বলবেন, আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ! (বুখারি, 7510; মুসলিম, 19)
এই সেই মানুষ যার সুন্নাহকে আজ আমরা তুচ্ছ করছি। সেই মানুষ যার অপমান, অবমাননা আমরা নির্বিকারভাবে সয়ে যাচ্ছি। যার অবমাননাকারীদের আমরা নির্বিঘ্নে আগ্রাসন চালিয়ে যেতে দিচ্ছি। এটা হলো সেই মানুষটা, যিনি গভীর রাতে সালাতে দাঁড়িয়ে তোমার আর আমার কথা চিন্তা করে কাঁদতেন। যিনি বারবার আল্লাহর কাছে তাঁর উম্মাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
এটা হলো সেই মানুষটা যিনি আমাদের দেখেননি, কিন্তু আমাদের জন্য বারবার চিন্তিত হয়েছেন, কান্না করেছেন, দুআ করেছেন। এটা হলো সেই মানুষটা, যিনি সুপারিশ করবেন, সেই ভয়ঙ্কর দিনে, তাঁর উম্মাহর জন্য। আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ।
এই মানুষটার কথা স্মরণ করো। যেই মহান সত্ত্বা তাঁকে প্রেরণ করেছেন তাঁর ব্যাপারে সচেতন হও। নিজের পরিবার, আর প্রাণের জন্য ভালোবাসাকে এক পাল্লায় তুলে এই মানুষটার জন্য তোমার মনে যে ভালোবাসা আছে সেটাকে অন্য পাল্লায় রাখো। দুনিয়ার মায়া, সম্পদ, গা-বাঁচানো জীবনকে এক পাল্লায় তোলো আর রাসূলুল্লাহর সম্মানের প্রশ্নকে আরেক পাল্লায় তোলো।
পুরো পৃথিবীকে এক পাল্লায় তোলো আর মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহ ﷺ-কে আরেক পাল্লায় তোলো। আর বিচার করো, তুমি আসলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কতটুকু ভালোবাসো। নিজেকে প্রশ্ন করো, এই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি দায়িত্ব তুমি কতটুকু পালন করেছ। চিন্তা করো, যদি হাশরের দিন তাঁর ﷺ সাথে তোমার দেখা হয়, আর এই প্রশ্নগুলো তিনি ﷺ তোমাকে করেন, তাহলে কী জবাব দেবে?
“অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের যে দুঃখ-কষ্ট হয়ে থাকে তা তার জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি দয়ালু করুণাশীল ও অতি দয়ালু।” (সূরা আত-তাওবাহ, ১২৮)