তাড়াহুড়া

সকল কাজে তাড়াহুড়ো করার অভ্যাস আমার। এজন্যে কতোবার যে পরীক্ষায় অংক ভুল করেছি তার ইয়ত্তা নেই। সেই সাথে লজ্জিতও হতে হয়েছে অনেকবার। ক্লাসে, বাড়িতে বা বাহিরে। দুই একটা ঘটনা তোমাদের বলি। শোনো তাহলে…

ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। বিজ্ঞান বইয়ের একটা প্রশ্ন ছিল রূপান্তরিত মূল ও কাণ্ডের কাজ। স্যার একদিন ক্লাসে এসে এই প্রশ্নের উত্তর লেখতে দিলেন। তাড়াহুড়ো করা আমার স্বভাব। আগেই বলেছি। ভাবলাম সবার আগে লেখা জমা দেব আর স্যারের কাছ থেকে সাবাশি নেব। যেই ভাবা সেই কাজ। তাড়াহুড়ো করে দ্রুত লিখে ফেললাম। হাতের লেখা কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এর চাইতেও খারাপ হলো। কিন্তু হু কেয়ারস? কলারটা উঁচিয়ে নিলাম। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে একটা স্টাইল করে নিলাম। এরপর স্যারের কাছে গিয়ে খুব জোরে বললাম – স্যার, শেষ (যেন সবাই শুনতে পায়) স্যার খাতা পড়ছেন। বাকিরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সেই ভাব নিচ্ছি। হাসানের দিকে তাকালাম। মুখ কালো হয়ে আছে ওর। মনে হলো ও হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। আমাকে ও একবারেই দেখতে পারে না। সারাদিন খালি ফার্মের মুরগির মতো পড়ে আর ঝিমায়। খেলাধুলা কিচ্ছু করে না।

স্যার হঠাৎ থেমে গেলেন। মোটা ফ্রেমের চশমাটা স্যারের নাকের ডগায় নেমে এসেছিল। স্যার চশমার কাঁচের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ব্যাপার কী? চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না স্যার কি ভাবছেন। ঝড় আসবে নাকি প্রশংসার বৃষ্টি?

স্যার  হঠাৎ বাজখাঁই গলায় হাঁক দিলেন- হাসান, এদিকে আয়।  হাসান প্রায় উড়ে আসল। স্যারের মুখটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে এখন। আমি ভাবলাম স্যার মনে হয় হাসানকে আমার খাতা দেখিয়ে বলবেন যে দেখ এভাবেই লিখতে হয় প্রশ্নের উত্তর। খুব গর্ব হচ্ছিল। হাসান ব্যাটাকে পাইছি আজকে। স্যার, হাসানকে বললেন- নে এই জায়গাটা জোরে জোরে পড়। হাসান বুঝে নিল কোথায় পড়তে হবে। এরপর জোরে জোরে পড়ল- রূপান্তরিত মলের কাণ্ড!

স্যারসহ পুরো ক্লাস অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমার কান লজ্জায় গরম হয়ে গেল। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। কোনোমতে বেঞ্চে ফেরত এসে মাথা নিচু করে থাকলাম বাকিটা দিন!

এরপর আর একটা ঘটনা বলি। এটা ক্লাস এইটে বা নাইনে থাকতে ঠিক খেয়াল নেই। চাচার বাসায় বেড়াতে গেছি। দুপুরে খাবার পর সবাই শুয়ে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। আমাকে চাচা সেদিনের হলুদ আলো পত্রিকা দিয়ে বললেন, পড়ে শোনা। চোখটা একটু বুজে আসছে।

আমি পড়তে শুরু করলাম। ঠিকই ধরেছ- একেবারে বুলেটের বেগে। সামনে বসে আছে পিচ্চি ছোট ভাই। নিরীহ চেহারা দেখে মানুষ ধোঁকা খায়। ভাবে ছেলে খুব ভদ্র। কিন্তু খুব ডানপিটে। যাই হোক, জোরে  জোরে পড়ার কারণে আমার মুখ থেকে মাঝে মাঝে থুতু বের হয়ে ওর মুখে পড়ছিল। আমি ইচ্ছা করেও এমন করছিলাম। ওকে শাস্তি দেবার জন্য। ও কিছু বলতে পারছে না। কারণ চাচাকে ও খুব ভয় পায়। একটা খবর পড়ে আর একটা খবরের শিরোনাম শুরু করেছি কেবল। সেই সময় সে পেয়ে গেল প্রতিশোধের সুযোগ।

আমি জোরে জোরে পড়লাম- ম্যারাডোনা[1] মা হলেন!

চাচা সঙ্গে সঙ্গে আধশোয়া থেকে সটান উঠে বসলেন। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন- পাবনার বিশেষ হাসপাতালের বিশেষ ডাক্তার এই মাত্র ভর্তি হওয়া নতুন রোগীর দিকে তাকিয়ে আছে! আমি বুঝলাম না ব্যাপার কী।  ওদিকে পিচ্চি ছোটভাই হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওর হাসাহাসির শব্দ শুনে সুমি আপা আর চাচীও পর্দার ঐপাশ থেকে উঁকি দেবার চেষ্টা করছে। বহু কষ্টে ট্যাটন ছোটভাই হাসি থামাল। এরপর বলল- তা ভাইয়া, তুমি কবে মা হবে?

আমি সঙ্গে সঙ্গে শিরোনামের দিকে তাকালাম। দেখি সেখানে লেখা- ম্যারাডোনা মা হারালেন!!

এরপর বুঝতে পারলাম তাড়াহুড়ায় আমি কি পড়েছি। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার অবস্থা আমার!

শেষ একটা ঘটনা বলি। এটা এসএসসি পরীক্ষার পর যে ছুটি থাকে সে সময়কার ঘটনা। মামার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি। মামা বদলি হয়ে নতুন একটা এলাকায় গেছেন। বাসার ঠিকানা দিয়েছেন। কিন্ত আমি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে বাস থেকে ঐ ঠিকানার কিছু আগে অন্য একটা জায়গায় নেমে গেছি। নামার পর বুঝতে পারলাম ভুল হয়েছে। এমন সময় মামা ফোন দিলেন।

– কি ভাগ্নে কতোদূর?

আমি তো জায়গার নাম জানি না। রাস্তার পাশে একটা দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম জায়গার নাম লেখা আছে। ওইটাতেই দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে মামাকে বললাম

– মামা, আমি চৌপাছা আছি!

ঐ পাশ থেকে মামাতো ভাইদের খুক খুক করে হাসির আওয়াজ পেলাম। মামাও হাসছেন। বুঝলাম ফোন লাউড স্পিকারে আছে। এবং আরও বুঝলাম কোথাও একটা ঝামেলা করেছি।

ভালো করে সাইনবোর্ডের দিকে তাকালাম। দেখি সেখানে লেখা

                                      চৌগাছা!!

লজ্জায় সাথে সাথে ফোন কেটে দিলাম।

এই তাড়াহুড়া করার অভ্যাস, অস্থিরতা একটু বয়স বাড়লে ঠিক হয়ে যায়। আমারও আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছে। কিন্তু এটার কারণে কতো লজ্জা, অপমান, বাবা-মার পিটুনি, শাস্তি যে খাওয়া লাগল! সেদিন একটা হাদীস পড়লাম।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল কাইস গোত্রের এক সাহাবিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন: তোমার মাঝে দুটি গুণ আছে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পছন্দ করেন: . সহনশীলতা, . ধীরস্থিরতা। [2]

এসো আমরা নিজেকে বলি- আমরা তাড়াহুড়া করব না। ধীরস্থির হব। বুঝেশুনে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করব। তাহলে জীবন হবে পানির মতোই সহজ।

আর একটা কথা…

[বিঃ দ্রঃ আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারলাম, তাড়াহুড়ায় দ্রুত লিখতে গিয়ে লেখক কলমের নিব ভেঙ্গে ফেলেছে। তাই -আর একটা কথা- আর জানা গেল না। – ষোলো ভাইয়া]


[1] ম্যারাডোনা একজন পুরুষ।

[2] সহিহ মুসলিম ১৮, সহিহ ইবনু হিব্বান ৪৫৪১


by

Tags: