দীপু বসে আছে শহিদুল সাহেবের অফিস ঘরে। এক কামরার অফিস। অফিসের মাঝখানে বিশাল আকৃতির টেবিল পাতা রয়েছে। যার এক পাশে বসে আছে দীপু, অন্য পাশে শহিদুল সাহেব। টেবিলের ওপর শহিদুল সাহেবের ব্যবসার বেশ কিছু টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি সেই টাকাগুলো সাজিয়ে নিয়ে গুনতে শুরু করেছেন। দীপুর দিকে একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। অপেক্ষা করছে দীপু। শহিদুল সাহেব একবার চোখ তুলে তাকালেই কথা বলা শুরু করতে পারে সে। সমস্যা হলো কথার শুরুটা কীভাবে করবে, দীপু ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কেন এসেছে, সেই বিষয়টা উপস্থাপন করতে যেই পরিমাণ সাহস তার প্রয়োজন সেটা এখনো বুকে ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জীবনে প্রথম এমন অপরিচিত কারও কাছে টাকা চাইতে এসেছে সে। ভিক্ষা কিংবা সাহায্য নয়, ঋণ চাইবে।
বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীপুকে কখনো এভাবে টাকার জন্যে অন্যের কাছে ছোটাছুটি করতে হয়নি। সুখের সংসার ছিল দীপুদের। বাবা-মা আর দীপু মিলে ছোট্ট সুখের সংসার। বাবা মারা যাওয়ার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মা এখন খুব অসুস্থ। দীপু মাত্র এসএসসি পাশ করেছে। ঘরে কামাই রোজগার করার কোনো মানুষ নেই। বাবার জমানো কিছু টাকা ছিল। তার মৃত্যুর পর, সেই টাকা ভেঙেই চলেছে দীপুদের সংসার। এরপর আত্মীয়-স্বজনরা কিছুদিন সাহায্য সহযোগিতা করেছে। ইদানীং আত্মীয়রা আর সাহায্য করার আগ্রহ পাচ্ছে না। আজ সকালে মায়ের ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। দু-বেলা খাবার যোগাড় করা যে সংসারে কঠিন কাজ, সেখানে ওষুধ কেনা এক রকম বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু মায়ের শরীরের যে অবস্থা, তাতে ওষুধ না-দেয়া হলে আল্লাহ না করুক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দীপুর। তাই মাকে কিছু না-বলে, ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়েছে দীপু। প্রথমে গিয়েছিল বড় চাচার বাসায়। এর আগে কয়েকবার অল্প কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বড় চাচা। এবার দীপুর কথা শুনে মুখ গম্ভীর করে বললেন :
এলোপ্যাথি ওষুধ তো আসলে ওষুধ না। ওগুলো বিষ। আমি নিজেও আগে এক গাদা ওষুধ খেতাম। এখন বেশির ভাগই ছেড়ে দিয়েছি। ইদানীং আমি ভেষজ ট্রিটমেন্ট নিচ্ছি। বুঝলি দীপু, আসল ওষুধ হলো ভেষজ ওষুধ। তোর মাকে এলোপ্যাথি না খাইয়ে, বরং ভেষজ খাবার খাওয়া। বুকে ব্যথার জন্যে পাথর চুনা পাতা লবণ দিয়ে খেতে বল। জাদুর মতো কাজ করবে। গলায় কফ জমলে তুলসী পাতা পেস্ট করে, সেই পেস্ট খাইয়ে দিবি। সব ঠিক হয়ে যাবে বুঝলি। ডায়াবেটিস অতিরিক্ত বেড়ে গেলে খাওয়াবি নিম পাতার রস এক চামচ করে। ব্যাস, দেখবি ডায়াবেটিস পেছনের দরজা দিয়ে পালাবে। আমার ছাঁদে পাথর চুনা পাতা আর তুলসী পাতা দুটোই হয়েছে। ছাদে গিয়ে প্রয়োজন মতো ছিঁড়ে নিয়ে যা। পাশের বাসার উঠানে একটা বড় নিম গাছ আছে। সেখান থেকে নিম পাতা নিয়ে যেতে পারিস।
বড় চাচা কী বলতে চাইছেন, সহজেই বুঝল দীপু। সে ছাদে গিয়ে পাথর চুনা পাতা কিংবা তুলসী পাতা আনল না। মাথা নিচু করে বের হয়ে এল বড় চাচার বাড়ি থেকে। এরপর গেল একমাত্র মামার বাসায়। মামার কাছে টাকা চাইতেই, তিনি ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তোর চাচার কাছে গিয়েছিলি?
– দীপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
– কী বললেন তিনি?
– কিছু বলেনি।
– টাকা দেয়নি তোকে?
দীপু চুপ করে রইল। মামা কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,
– এ কেমন কথা। তোর চাচার তো একটা দ্বায়িত্ব আছে না-কি? নিজের ছোট ভাইয়ের সংসারকে সে এভাবে অবহেলায় ফেলে রাখতে পারে না। তুই এখনি তার কাছে আবার যাবি। এবং জোর গলায় তোর দাবি জানাবি। এখুনি চলে যা। দেরি করিস না।
দীপু দেরি করল না। দ্রুত বেরিয়ে এল মামার বাসা থেকে। মনটা ভীষণ খারাপ করছিল দীপুর। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল শহিদুল সাহেবের কথা। বাবার একমাত্র বন্ধু, যিনি বাবাকে ধরে ধরে মাসজিদে নিয়ে যেতেন। বাবার থেকে বয়সে অনেক বড় হলেও বাবার সাথে বেশ সখ্য ছিল শহিদুল সাহেবের। বড় একজন ব্যবসায়ী তিনি। দীপু দু-একবার বাবার সাথে শহিদুল সাহেবের অফিসে এসেছিল। শহিদুল সাহেবের অফিসে এলেই দীপুর হাতে সৌদি থেকে আনানো কাঁচা খেজুর তুলে দিতেন শহিদুল সাহেব। দীপু বেশ মজা নিয়ে খেত। আজকে যখন দীপু তার মামা-চাচার কাছ থেকে মায়ের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হলো, তখনই কী মনে করে ছুটে এল শহিদুল সাহেবের অফিসে। এরপর থেকেই দীপু তার সামনে বসে আছে। শহিদুল সাহেব বেশ কিছুক্ষণ পর দীপুর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিলেন। হাসির উত্তরে হাসি উপহার দিতে হয়। এটাই নিয়ম। দীপুর এখন মোটেই হাসিমুখ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও নিয়ম রক্ষার্থে সে খানিকটা হাসার চেষ্টা করল। শহিদুল সাহেব বললেন :
– কিছু মনে কোরো না। তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না, বাবা।
– আমি দীপু। আপনার বন্ধু রহমত সাহেবের ছেলে আমি।
– ওহ আচ্ছা। রহমত ভাইয়ের ছেলে তুমি।
– জি।
খুব ভালো মানুষ ছিলেন তোমার বাবা। নিয়মিত সালাত পড়া শুরু করেছিলেন। তাওবা করে ফিরে এসেছিলেন দ্বীনে। আল্লাহ উনাকে কবুল করুন। তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, দুঃখিত।
দীপু লজ্জিত গলায় বলল, অসুবিধা নাই।
শহিদুল সাহেব মুখের হাসি প্রশস্ত করে বললেন,
টাকা পয়সা গণনার ক্ষেত্রে আমি বেশ কাঁচা মানুষ বুঝলে দীপু। এই দেখো না কত টাকা এখনো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ভেবেছিলাম সব টাকা গুছিয়ে, গুনে শেষ করে তারপর তোমার সাথে কথা শুরু করব। এখন বুঝতে পারছি সেটা সম্ভব হবে না ।
দীপু বিনয়ের সাথে বলল,
– আপনি কাজ শেষ করেন, আমি পরে আসব।
– না না, বসো তুমি। আমি পরে গুনে নেব, সমস্যা নেই।
বলেই টাকাগুলোকে একসাথে করে একটা পেপার ওয়েট দিয়ে চাপ দিয়ে রাখলেন শহিদুল সাহেব।
হাসিমুখে বললেন,
– এখন বলো, কী জন্যে এসেছ?
– আপনাকে দেখতে এসেছি।
কথাটা বলেই রাগে দীপুর গা জ্বলে উঠল। সে এসেছে টাকা চাইতে। ভণিতা না করে সরাসরি চেয়ে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। ধার চাইতে এসেছে সে, ভিক্ষা নয়। সুতরাং তার এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তারপরও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মুখ ফুটে টাকার কথা বলতে পারছে না দীপু। তার মাথা ঘুরাচ্ছে।
তবে শহিদুল সাহেব দীপুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। বরং দীপুর কথা শুনে তার চোখ চক চক করতে শুরু করেছে। তিনি আদুরে গলায় বললেন, বাহ! যেমন বাবা, তেমনই তার ছেলে। তোমার বাবাও কিন্তু আমাকে দেখতে হুট হাট আমার কাছে চলে আসতেন। বিশেষ করে গত রমাদানে প্রতিদিনই আমি আর তোমার বাবা একসাথে হয়ে অনেক গল্প করেছি।
দীপু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে :
কী গল্প করতেন বাবা আপনার সাথে?
– সে অনেক গল্প। রমাদানে সব রমাদান বিষয়ক গল্প হতো। সাওম রাখার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হতো।
দীপু গম্ভীর গলায় বলল, বাবা গত বছরই প্রথম রমাদান মাসে সাওম রাখা শুরু করেছিলেন।
হ্যাঁ। তোমার বাবা নাস্তিকতা থেকে দ্বীনে ফিরে আসার পর সেটাই ছিল তার জীবনের প্রথম রমাদান। এবং তিনি অত্যন্ত যত্নের সাথে সব গুলো সাওম রেখেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ।
দীপু মাথা নিচু করে বলল, আমাকেও বাবা গতবার অনেক অনুরোধ করেছিলেন সাওম রাখতে। আমি রাখিনি।
– তুমি কি আল্লাহকে বিশ্বাস করো, দীপু?
– হুম, বিশ্বাস করি। বাবা যখন অবিশ্বাসী ছিলেন, তখনো আমি আর মা আল্লাহকে বিশ্বাস করতাম। এখনো করি।
– তাহলে সাওম কেন রাখোনি?
– খিদে লেগে যায়। অভ্যাস নেই।
শহিদুল সাহেবের মুখে এতক্ষণ প্রশস্ত হাসি ছিল। সেই হাসি একটু মিইয়্যে গেছে। তিনি গম্ভীর মুখ করে বললেন, দেখো দীপু, আল্লাহ ঈমানদারদের জন্যে রমাদান মাসের সাওম ফরয করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর সাওম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’[1]
এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের বলেছেন যে, ঈমানদারদের জন্যে সাওম রাখা ফরয। তোমাকে মজার একটা তথ্য দিই দীপু। এই আয়াতের দিকে লক্ষ করো- সাওম যে কেবল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উম্মাতের ওপরই ফরয করা হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। পূর্ববর্তী নবিগণ এবং তাঁদের উম্মাতের ওপরেও সাওম ফরয ছিল। সাওমের মূল উদ্দেশ্য কী, বলতে পারবে?
– জি না।
সাওমের মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। ইসলামের যে পাঁচটি ভিত্তি আছে, সাওম তার মধ্যে অন্যতম। বুখারি আর মুসলিমের একটা হাদীসে বলা হয়েছে,
‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। ক. এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। খ. সালাত কায়েম করা। গ. যাকাত আদায় করা। ঘ. হাজ্জ পালন করা এবং ঙ. রমাদানের সাওম রাখা।’[2]
তুমি কি আমার কথা শুনছ, দীপু?
দীপু মাথা নিচু করে বসে ছিল। এবার মাথা উঁচিয়ে হেসে বলল, জি শুনছি।
শহিদুল সাহেব বললেন, এ বছরের রমাদান মাসও তো চলে এল বলে। আগে কী করেছ সেটা ভুলে যাও। এবারের রমাদান থেকে সাওম রাখা শুরু করে দিয়ো, কেমন?
চাচা, বাবা আগে রোজা রাখতেন না একদম। তাই আমিও রাখতাম না। এখন একদম অভ্যাস চলে গেছে রোজা রাখার। আর তাছাড়া, আমি তো অনেক গুনাহ করি। এরকম গুনাহগার হয়ে রোজা রেখে কী লাভ।
শয়তানকে সুযোগ দিয়ো না, দীপু। সে তোমাকে বাজে লজিক দিয়ে সাওম থেকে বিরত রাখতে চাইবে। শয়তানের কথায় ভুল করবে না। বরং তুমি যদি গুনাহগার হও, তোমার উচিত রমাদান মাসের সাওমের সাথে পরবর্তী নফল সাওমও রাখা। সাওম কিন্তু গুনাহ মাফের একটি মাধ্যম ।
রমাদান মাসের সাওম এতটা মহিমান্বিত একটি আমল, যার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বান্দার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সাওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমাদান মাসে সাওম রাখবে, তার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।’[3]
দীপু বুঝতে পারছে, এই বৃদ্ধ তাকে পেঁচিয়ে ফেলছে। বৃদ্ধের কথায় অদ্ভুত এক আকর্ষণ আছে। তার কথা শুনতে নেশার মতো হয়ে যায়। ভালো লাগে। তবে বৃদ্ধর কথার প্যাচ আরেকটু শক্ত হলে, এখান থেকে উঠে বের হওয়াই মুশকিল হবে। মুখ ফুটে মায়ের ওষুধের জন্যে টাকার কথাটা আর বলা হবে না। যা বলার এখনই বলতে হবে তাকে।
দীপু ইতস্তত করে বলল, চাচা একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম ।
শহিদুল সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীপুর দিকে। দীপুর প্রশ্ন শোনার আগ্রহ তার মধ্যে বেশ কাজ করছে।
দীপু বলল, চাচা যারা নিদারুণ অর্থ কষ্টে ভুগছে , এমন মানুষদের জন্যেও কি সাওম ফরয?
শহিদুল সাহেব ডান হাত দিয়ে টেবিলে হালকা চাপর দিয়ে বলল, আলবৎ। তাদের জন্যেও সাওম ফরজ। আরে ব্যাটা, সাওমের প্রতিদান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে স্বয়ং নিজে দেবেন। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,
‘আল্লাহ তাআলা বলেন, সকল আমলের সাওয়াব তো (একরকম) নির্ধারিত। অর্থাৎ প্রতিটি নেকি দশ থেকে সাতশ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে রোজার বিষয়টি এর ব্যতিক্রম। কেননা সাওম একমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে। আর তাই এর প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দেবেন।’[4]
দীপু ভ্রু কুঞ্জিত করে জিজ্ঞেস করল,
স্বয়ং আল্লাহ পুরষ্কার দেবেন ভালো কথা। কিন্তু পুরস্কারটা কী?
আল্লাহ কেমন প্রতিদান দেবেন তা আল্লাহ্-ই ভালো জানেন দীপু। আমরা শুধু বুঝি, যে প্রতিদান আল্লাহ বিশেষভাবে দেবেন তা তাঁর শান মোতাবেক দেবেন। সাওমের ক্ষেত্রে বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে এত বড় সম্মান ও পুরস্কার এ জন্য যে, সাওম সাধারণত আল্লাহর জন্যই হয়ে থাকে। অন্যান্য আমলের তুলনায় সাওমের ক্ষেত্রে রিয়ার আশঙ্কাও কম থাকে। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, সাওম আমার জন্য। আর এজন্যই আল্লাহ নিজে সাওমের প্রতিদান দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, সাওম কিন্তু তোমার ঢাল হিসেবেও কাজ করবে। মুমিনের সাওম তার জন্য ঢাল হবে। অর্থাৎ ঢাল যেভাবে মানুষকে রক্ষা করে তেমনি সাওমও সায়িমকে রক্ষা করবে। তাকওয়া হাসিলের প্রতিবন্ধকতা থেকে, গুনাহ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে, প্রবৃত্তি অবদমিত করার ক্ষেত্রে, কবরে-হাশরে এবং আখিরাতের সকল ঘাঁটিতে, এমনকি জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে সাওম আল্লাহর ইচ্ছাতে একজন সায়িমকে রক্ষা করবে।
হাদীসে এসেছে-
‘সাওম ঢাল স্বরূপ, যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, কীভাবে তা বিদীর্ণ হয়? নবিজি বললেন,
‘মিথ্যা অথবা গীবতের মাধ্যমে।’[5]
দীপু শহিদুল সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। শহিদুল সাহেব হাত ইশারায় দীপুকে চুপ করতে বললেন। এরপর এক গ্লাস পানি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে গলায় চালিয়ে দিয়ে, সাওম বিষয়ে বিশেষ এক লেকচার শুরু করে দিলেন। দীপু বুঝতে পারল, তার কিছুই করার নেই, সে যেই পেঁচিয়ে পড়ার ভয় করছিল সেই প্যাঁচ লেগে গেছে। সে শহিদুল সাহেবের কথার প্যাঁচে আটকে গেছে। তবে আজব ব্যাপার হলো পুরো লেকচারটা শুনতে দীপুর একটুও খারাপ লাগেনি। বরং ভালো লাগছিল। মাঝে মাঝে হুট করে তার মনে হচ্ছিল, শহিদুল সাহেবের জায়গায় বাবা বসে আছেন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লেগেছে তার কাছে। শহিদুল সাহেব তার বিশাল লেকচারে সাওমের বিষয়ে বেশ কিছু ইনফরমেশন দিয়েছেন, যা দীপুর কাছে একদম নতুন লেগেছে। সেগুলোর একটা লিস্ট দীপু মনে মনে করে ফেলেছে। সেগুলো হলো :
- সায়িমের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চেয়েও অধিক প্রিয় : সায়িম ব্যক্তি দিনভর উপোস থাকে। অনাহারে থাকার দরুন তার মুখে একধরনের দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। দুনিয়াবি বিবেচনায় তা দুর্গন্ধ মনে হলেও আল্লাহর কাছে সেটা মিশকের চাইতেও অধিক প্রিয়। নবিজি ﷺ বলেন, ‘ঐ সত্তার কসম, যার কব্জায় মুহাম্মাদের প্রাণ, সায়িমের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক সুগন্ধিময়।’ [6]
- সায়িমে জন্য বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত : সায়িমের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হলো, ইফতারের সময়। অপরটি হলো, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে (আর তিনি তাকে বিশাল পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন)।[7] সায়িম ব্যক্তি দিনভর আল্লাহর হুকুমে উপবাস থাকার পর যখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ইফতারি নিয়ে বসে, তখন তার মনে অন্যরকম আনন্দ এবং অপার্থিব প্রশান্তির এক ঢেউ খেলে যায়। আর কিয়ামাতের ময়দানে যখন সে রবের নিকট থেকে সাওমের প্রতিদান গ্রহণ করবে, ঐ মুহূর্তটিও তার জন্য হবে অবারিত আনন্দের।
- সায়িমের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : সায়িম ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নিকট এতটাই মুহাব্বতের পাত্র যে, সে কিছু চাইলে আল্লাহ পাক তা ফিরিয়ে দেন না। নবিজি ﷺ বলেন, তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক. সায়িমের দুআ ইফতারের মুহূর্ত পর্যন্ত। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ। তিন. মাযলুমের দুআ। আল্লাহ এ দুআকে মেঘমালার ওপরে নিয়ে যান। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেন। রব বলেন, আমার ইজ্জতের কসম, বিলম্বে হলেও আমি তোমাকে সাহায্য করব।[8]
- সায়িমের জন্য সাওম সুপারিশ করবে : কিয়ামাতের দিন সায়িমের জন্য সাওম নিজে সুপারিশ করবে। হাদীসে এসেছে, ‘কিয়ামাতের দিন সাওম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সাওম বলবে, ওগো রব! দিবসে আমি তাকে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, রাতে আমি তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে।’[9]
- সায়িমের জন্য জান্নাতে প্রবেশের বিশেষ দরজা থাকবে : সায়িম ব্যক্তি হলেন আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহমান। নবিজি ﷺ বলেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। নাম রাইয়ান। কিয়ামাতের দিন তা দিয়ে সায়িমরা প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, সায়িমরা কোথায়? তখন তারা আসবে। তারা ছাড়া তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। সায়িমরা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর আর কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’[10]
শহিদুল সাহেব আল্লাহর পক্ষ থেকে রোজার প্রতিদানগুলো এত আকর্ষণীয়ভাবে বর্ননা করছিলেন, দীপুর মনে হচ্ছিল, রোজা রাখা শুরু করলেই দুনিয়াতে তার সব সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে। কারণ, আল্লাহই তার সমস্যা সমাধান করে দেবেন। দীপুর চোখে ঘোর লেগে আছে। শহিদুল সাহেবের কথা তার চোখে ঘোর তৈরি করেছে। শহিদুল সাহেবও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন। তিনিও কথা বলে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি খানিক নড়েচড়ে বসে আবার কথা শুরু করলেন।
দীপু কথা শুনতে খারাপ লাগছে ?
– জি না।
গুড। শোনো, রমাদানে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতে হয়। রমাদান মাস কুরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন এ মাসে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘রমাদান মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের দিশারী, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই সাওম রাখে।’[11]
সুতরাং এই মাসে কুরআনের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে।
দীপু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। শহিদুল সাহেব বললেন, ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দিই তোমাকে। আমাদের নবিজি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রমাদান মাসে সম্পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রমাদানে প্রতি রাতে নবিজির নিকট আসতেন। তিনি নবিজিকে পুরো কুরআন শোনাতেন এবং নবিজিও তাকে কুরআন কারীম শোনাতেন। নবিজি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তিকালের আগের রমাদানে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) দু-বার নবিজিকে কুরআন শুনিয়েছিলেন। একটি হাদীস আছে বুখারিতে এই ব্যাপারে।[12] আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, রমাদান মাসে আছে লাইলাতুল কদর। দীপু তুমি কী জানো, লাইলাতুল কদর কী?
দীপু ঘাড় নেড়ে বলল, সূরা কদর আমার মুখস্ত আছে।
– অর্থ জানো?
দীপু না সূচক মাথা নাড়ল।
শহিদুল সাহেব বললেন, কদর রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই রজনীতে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত।[13]
সুতরাং এই রাত রমাদানে খুঁজে নেওয়া দরকার। এবং এই রাতে সালাত, তাওবা-ইসতিগফার, দুআ-দরুদ বেশি বেশি করা দরকার। আর বিশেষ করে রমাদানের শেষ দশ রাতে ইবাদাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।
দীপু ভ্রুকুঞ্চিত করে বলল, এর কারণ কী?
এর কারণ হলো, হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী,
কদরের রাত সুনির্দিষ্ট নয়। তবে রমাদানের শেষ দশকে তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ হিসেবে নবি ﷺ রমাদানের শেষ দশকে ইবাদাতের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। আম্মাজান আয়িশা সিদ্দীকা (রদিয়াল্লাহু আনহা) নবিজির শেষ দশকের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ ﷺ অন্য দিনগুলোর তুলনায় রমাদানের শেষ দশকে বেশি ইবাদাত করতেন।’ [14]
তিনি আরও বলেন, ‘রমাদানের শেষ দশক শুরু হলে নবিজি পূর্ণরাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন এবং নিজে বেশি বেশি ইবাদাতের প্রস্তুতি নিতেন।’[15]
রমাদানের শেষ দশ দিনে একটি বিশেষ ইবাদাত আছে, যাকে বলে ইতিকাফ। এই সম্পর্কে কি তোমার কোনো ধারণা আছে?
শুনেছিলাম। মানুষজন মাসজিদে থাকে।
ঠিক শুনেছ। মাসজিদে শেষ দশ দিন থেকে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাত করার মজাই কিন্তু আলাদা। এবং এতে লাইলাতুল কদর মিস হওয়ার সম্ভাবনা একদম কমে যায়। রমাদানের ত্রিশ দিনের শেষ দশদিন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রমাদানের একটি বিশেষ আমল হচ্ছে সুন্নাত ইতিকাফ। রমাদানের খাইর-বরকত লাভে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই নবিজি রমাদানের শেষ দশকে মাসজিদে ইতিকাফ করায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ। নবিজি প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। আম্মাজান আয়িশা সিদ্দীকা (রদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
নবি ﷺ ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবিজির পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন।[16]
আবূ হুরায়রা (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
‘জিবরীল প্রতি বছর নবি ﷺ-কে একবার কুরআন শোনাতেন। কিন্তু যে-বছর তাঁর ওফাত হয়, সে-বছর দুই বার শোনান। নবিজি প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তিকালের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন।’[17]
কথার এ পর্যায়ে আযান হতে শুরু করল। আসরের আযান পড়ে গেছে। শহিদুল সাহেব কথা থামালেন। দীপু ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে ছিল শহিদুল সাহেবের দিকে। সেই ঘোর এখন কাটতে শুরু করেছে। শহিদুল সাহেব হাসি মাখা মুখে বললেন, কীভাবে সময় যায়, দেখেছ! কথা বলতে বলতে আসরের আযান হয়ে গেল। তোমাকে চা-পানি কিছুই সাধা হলো না।
– ওগুলো লাগবে না, চাচা।
– অবশ্যই লাগবে। রহমত সাহেবের ছেলে আমার কাছে এসে একদম খালি মুখে যাবে, সেটা হতে পারে না। তবে চলো আগে মাসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করি, ফেরার পথে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খেয়ে নেব।
এই কথা বলেই শহিদুল সাহেব তার পাঞ্জাবির হাতা কাচাতে শুরু করলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন,
– তুমি একটু বসো, আমি ওযু করে আসি। আমি আসলে তুমি ওযু করে নিয়ো।
– জি আচ্ছা।
শহিদুল সাহেব উঠে ওযু করতে গেলেন।
ঘরে এখন দীপু একা বসে আছে। ফ্যানের বাতাসে টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে চেপে রাখা টাকাগুলো উড়ে যেতে চাঁচ্ছে। একশ, পাঁচশ, হাজার টাকার অসংখ্য অগোছালো নোট। শহিদুল সাহেব এখনো হিসেব করে রাখেননি। দীপুর মনে শয়তান কু-মন্ত্রনা দিতে শুরু করল। সে মনে মনে ভাবল, এখান থেকে মায়ের ওষুধের টাকাটা নিয়ে নিলে কেমন হয়? শহিদুল সাহেবের কাছে চাইলে তিনি হয়তো দু-একশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেবেন। দীপুর দরকার দু-হাজার টাকা। এখান থেকে যদি সে দুই হাজার টাকা সরিয়ে ফেলে, শহিদুল সাহেব বুঝতেও পারবেন না। আল্লাহ তো শহিদুল সাহেবকে অনেক দিয়েছেন, সুতরাং তার থেকে দু হাজার টাকা না-বলে নিলে এমন কী হবে। মুখ ফুটে যখন সে টাকার কথা বলতেই পারছে না। সেহেতু না-বলে নিয়ে গেলেই হয়। মা কে বাঁচাতে জীবনে না-হয় প্রথম এবং শেষ বারের মতো চুরি করল সে।
দীপুর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। কী সব চিন্তা করছে সে। টাকাটা তার খুব দরকার। তাই বলে চুরি করবে! দীপু আরেক নজর পেপার ওয়েটের নিচে চাপা পরে থাকা টাকাগুলোর দিকে তাকায়। সময় হাতে একদম নেই। যা করার এখনই করতে হবে। শহিদুল সাহেব ওযু শেষ করে যেকোনো সময় চলে আসবেন। দীপু হুট করে পেপার ওয়েট তুলে এক হাজার টাকার দুটো নোট হাতে নিল। এরপর সময় নষ্ট না-করে ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাকি টাকাগুলো পেপার ওয়েটের ওজনের নিচে চাপা পরে রইল আগের মতোই।
২
পরের দিন সকাল বেলা। শহিদুল সাহেব তার অফিস ঘরে বসে আছেন একা। হাতে বিশাল মোটা এক বই। তিনি মনোযোগ দিয়ে বইয়ের পাতা উলটাচ্ছেন। দীপু ধীর পায়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
শহিদুল সাহেব বই থেকে মাথা না-উঠিয়ে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
দীপুর মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে খুব নীরবে এক হাজার টাকার দুটো নোট শহিদুল সাহেবের সামনে রাখল।
শহিদুল সাহেব আড় চোখে দীপুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীসের টাকা?
দীপু শান্ত গলায় বলল, গতকাল না-বলে নিয়েছিলাম।
সেটা জানি আমি। ফেরত দিচ্ছ কেন?
দীপু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কী বলবে সে?
শহিদুল সাহেব বেশ কিছুক্ষণ দীপুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মমতা জড়ানো গলায় বললেন,
– দীপু!
– জি?
– টাকা চুরি করতে গেলে কেন?
দীপু মাথা নিচু করে রইল। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। লজ্জায় মাথা উঠিয়ে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে সে। তারপরও শত আড়ষ্ঠতা ভেঙে দীপু গতকালের ব্যাপারটা বলল।
শহিদুল সাহেব দীপুর কথা শুনে সোজা হয়ে বসলেন। মোটা বইটা বন্ধ করে দীপুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মায়ের ওষুধের টাকা কি অন্য কোথাও থেকে জোগাড় হয়েছে?
– জি না।
– তাহলে টাকাটা ফেরত দিচ্ছ যে?
চুরির টাকা হারাম। এই টাকা দিয়ে মায়ের ওষুধ কিনব না।
আমার কাছে না-চেয়ে চুরি করতে গেলে কেন? চুরি করা অনেক বড় গুনাহের কাজ, দীপু। তুমি যখন চুরি করছিলে তখন কেউ ছিল না, কিন্তু আল্লাহ ছিলেন। তিনি কিন্তু দেখেছেন।
দীপু কোনো কথা বলল না। চুপ করে রইল। শহিদুল সাহেব বললেন, আমি চাইলে কি তোমাকে দিতাম না? চাইতে কি লজ্জা লাগছিল দীপু?
দীপু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শহিদুল সাহেবের কথার উত্তর দেওয়ার শক্তি তার নেই।
শহিদুল সাহেব বললেন, দীপু, এই দু-হাজার টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দিলাম। এটা তোমার।
দীপু এবার বড় বড় চোখ করে তাকায় শহিদুল সাহেবের দিকে। শহিদুল সাহেব হাসিমাখা মুখে বলেন, না না। এটা দান করছি না। তোমাকে এই টাকাটা আমি ধার দিচ্ছি। এবং এই ধার দেওয়ার শর্ত হলো, আমার দুই নাতিকে তুমি পড়াবে, এবার আমার সাথে রমাদানের শেষ দশ দিন মাসজিদে ইতিকাফে বসবে। এবং তোমার পড়ালেখার পাশাপাশি আমার ব্যবসাতে সময় দেবে। কি, পারবে না?
দীপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, সে পারবে।
দীপুর চোখে আগেও পানি ছিল। লজ্জার, অপমান এবং গ্লানির পানি। এখন আবারও আরেকবার দীপুর চোখ ভিজে উঠেছে। এবার দীপুর চোখের পানির রং এক হলেও, এর স্বাদ ভিন্ন। চোখের এই পানি শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। অন্ধকার থেকে আল্লাহর করুণার দিকে ফিরে আসার স্বচ্ছ, শুদ্ধ পানি।
[1] সূরা বাকারা, ২ : ১৮৩।
[2] বুখারি, ৮; মুসলিম, ১৬।
[3] বুখারি, ৩৮।
[4] মুসলিম, ১১৫১; বুখারি, ৫৯২৭।
[5] নাসাঈ, ২২৩০; মুসনাদু আহমাদ, ১৬২৭৮।
[6] বুখারি, ১৯০৪।
[7] মুসলিম, ১১৫১।
[8] তিরমিযি, ৩৫৯৮; ইবনু মাজাহ, ১৭৫২; মুসনাদু আহমাদ, ৯৭৪৩।
[9] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর, ১৪৬৭২; আরও দেখুন : হাইসামি, মাজমাউয যাওয়াইদ, ৫০৮১, ৩৩১০।
[10] মুসলিম, ১১৫২।
[11] সূরা বাকারা, ২ : ১৮৫।
[12] বুখারি, ৪৯৯৮।
[13] সূরা কদর, ৯৭ : ৩-৫।
[14] মুসলিম, ১১৭৫।
[15] মুসলিম, ১১৭৪; বুখারি, ২০২৪।
[16] মুসলিম, ১১৭২; বুখারি, ২০২৬।
[17] বুখারি, ৪৯৯৮, ২০৪৪।