রমাদানের সুবাসে সুবাসিত হও!

আগুন গরম বিকেল। প্রখর রোদে মাথায় খই ফোটার মতো অবস্থা। হঠাৎ ধূলি উড়ানো শীতল বাতাস। কিংবা এক পশলা ঝুম বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি বাতাসের পেলব ছোঁয়ায় এক অনাবিল প্রশান্তির ধারা বইতে শুরু করে হৃদয়-জমিনে।

রমাদান ঠিক এরকমই একটা ব্যাপার। বছরের বাকি সময়টায় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, ছোট-বড় আর জানা-অজানা পাপের তাপে আমরা যখন হাঁপিয়ে উঠেছি, ঠিক তখনই হৃদয়ে প্রশান্তির স্নিগ্ধ পরশ বুলাতে হাজির হয়েছে ‘শাহরু রমাদান’। বছরের সেরা মাস।

রমাদানে আমরা নিজেদের গুনাহগুলো মাফ করিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ পাই। রাসূলুল্লাহ  ﷺ বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমাদানে সাওম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’[1] 

তাই রমাদানে আমাদের লক্ষ্য থাকবে—নিজেদের গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়া, নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। আমাদের রমাদান যেন স্রেফ কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মাঝেই সীমাবদ্ধ না থাকে। ইফতার পার্টি আর সেহরি নাইট সেলিব্রেইট করতে করতেই যেন আমাদের রমাদান চলে না যায়। রমাদান নামের শীতল বাতাসে আমরা যেন নিজেদের প্রশান্ত করতে পারি। নিজেদের পাপের বোঝা হালকা করে, এক বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে অনন্ত সুখের জান্নাতে নিজেদের নাম লিখিয়ে নিতে পারি।

ভাইয়া এবং আপুরা, অগণিত ফযিলতের এই মাসে প্রত্যেকের উচিত নিজেদের সেরা আমল করা। সেজন্য পুরো মাসের জন্য একটি রুটিন বানিয়ে নিতে পারো তোমরা।[2]  

প্রথমেই বলে নিই, নিজের ওপর প্রেসার নেবে না। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করবে না, যা তুমি করতে পারবে না। ধরো, তুমি ঠিক করলে প্রতিদিন তিন পারা করে কুরআন পড়বে। কিন্তু তোমার যে ব্যস্ততা, তাতে হয়তো দৈনিক এক পারা কুরআন পড়তে পারতে। এখন এই অতিরিক্ত লক্ষ্য পূরণের জন্য তোমার ওপর অনেক প্রেসার পড়বে। প্রথম কয়েকদিন হয়তো তুমি চাপ নিয়ে হলেও তিন পারা করে পড়তে পারবে। কিন্তু পরে একদিন মিস হয়ে গেলেই তোমার অলসতা চলে আসবে। অবচেতন মনেই তোমার অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে—আমি তো পারছি না। তখন একেবারেই কুরআন পড়া হবে না। আসলে আমরা অধিকাংশই এমন। লক্ষ্য নির্ধারণের সময় এমন টার্গেট ঠিক করি, যা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব না। তাই, তোমার অবস্থা বুঝে লক্ষ্য নির্ধারণ করো। পরিমাণ কম হোক, কিন্তু তা যেন প্রতিদিন করতে পারো।

  • সালাতে হও অগ্রগামী

যদি বছরের অন্যান্য সময় তুমি সালাত না আদায় করো, তাহলে এ মাসে নিয়মিত সালাত আদায় করো। সালাতের দুআ ও ছোট ছোট সূরাগুলোর বাংলা অর্থ জেনে নাও। যদি তুমি অন্যান্য সময়েও পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে থাকো, তাহলে এ মাসে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করো। তারাবীহ পড়ো। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করো। নফল সালাতের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে শেষ রাতের সালাত।[3] এটা হলো দুনিয়ার বুকে মুমিনের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এটি দুনিয়া ও আখিরাতে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে। তাই প্রতিদিন সাহরির কিছু আগে জেগে উঠো। কিছু সময় কিয়ামুল লাইল আদায় করো। ধীরস্থিরভাবে। 

  • কুরআনকে বন্ধু বানাও

যদি তুমি কুরআন পড়তে না পারো, তাহলে এটাই সময়—শিখে নাও। যদি তুমি কুরআন পড়তে পারো, কিন্তু উচ্চারণ শুদ্ধ নয়, তাহলে উচ্চারণ শুদ্ধ করে নাও। আর এসবের পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন পড়ো। চ্যালেঞ্জ নাও কুরআনের ছোট ছোট সূরা মুখস্ত করার। আর যদি তুমি এসব আগে থেকেই পারো, তাহলে চেষ্টা করো রমাদানে পুরো এক খতম দিয়ে দিতে।

  • যিকরে সিক্ত করো তোমার জিহ্বা

যান্ত্রিক এই দুনিয়ায় অশান্তির শেষ নেই। দিনশেষে এক মুঠো প্রশান্তির খুঁজে মরিয়া থাকি আমরা সবাই। প্রশান্তি খুঁজে বেড়াই প্রেম-ভালোবাসা, গান, মুভি বা অন্যকিছুতে। অথচ প্রশান্তি যেখানে পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারে আমরা একেবারেই বেখেয়াল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,

‘…জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’[4]

তুমি যদি আগে একেবারেই যিকর না করে থাকো, তাহলে এ মাসে প্রতিদিন ১০ বার সুবহানাল্লাহ  (আল্লাহ পবিত্র), ১০ বার আলহামদুলিল্লাহ (সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য), ১০ বার আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান) যিকর করো।

তোমার যদি আগেও যিকরের অভ্যাস থেকে থাকে, তাহলে ফরয সালাতের পর পঠিতব্য মাসনূন যিকর-আযকার ও সকাল সন্ধ্যার ২৩ আযকার মিস দিয়ো না। এগুলো সবই পাবে হিসনুল মুসলিম বই বা অ্যাপে।। তুমি যদি আগে থেকেই এগুলোর ওপর আমল করে থাকো, তাহলে সহজ ১০টি যিকরের আমল করো। সহজ ১০টি যিকর শিখে নাও এখান থেকে

  • সীরাতকে করো অবসরের সঙ্গী

মুহাম্মাদ ﷺ -কে আমরা প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। তাঁর জন্য আমরা জীবনও দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমাদের অনেকেরই তাঁর জীবনীটুকুও পড়া নেই। আমরা তাঁকে ভালোমতো চিনিই না। তাই এ মাসে চেষ্টা করো তাঁর জীবনী অধ্যায়ন করতে। প্রিয় নবিজির সীরাতকে করে নাও তোমার অবসরের সঙ্গী। পড়তে পারো ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’

সেই সাথে শুনে ফেলতে পারো মুহাম্মাদ ﷺ-এর জীবনী নিয়ে সাজানো এই চমৎকার লেকচার সিরিজ ‘সীরাহ’

যদি আরও বেশি পড়তে চাও, তাহলে পড়ে ফেলতে পারো সাহাবিদের জীবনী নিয়ে চমৎকার চমৎকার বইগুলো।

  • সাদাকাহ করো বেশি বেশি

অন্যান্য মাসের তুলনায় রমাদানে দান-সাদাকাহ বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। প্রতিদিন অন্তত কিছু কিছু সাদাকাহ করার চেষ্টা করো। ৫ টাকা হোক সমস্যা নেই, কিন্তু প্রতিদিন দাও। আমল ছোট হলেও তা নিয়মিত করলে আল্লাহ তা পছন্দ করেন। যদি তোমার সামর্থ্য বেশি থাকে, তাহলে আরও বেশি টাকা দিতে পারো।

সাদাকাহ করার সময় ভয় পেয়ো না। সাদাকাহ সম্পদ কমায় না; বরং তাতে বারাকাহ আনে এবং সম্পদ পবিত্র করে। সাদাকাহ আল্লাহর ক্রোধকে নিভিয়ে দেয়। নবিজি ﷺ অন্যান্য মাসের তুলনায় রমাদানে অনেক বেশি সাদাকাহ করতেন। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি বেশি সাদাকাহ করো। মনে রেখো, এই মাসে যা-ই ইনভেস্ট করবে, আখিরাতে তা কয়েকশ গুণ হিসাবে পাবে।

  • গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো

সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। বিশেষ কোনো গুনাহের অভ্যাস থাকলে এ মাসেই তা থেকে স্থায়ীভাবে তাওবা করে নাও। যেমন : নাটক-সিনেমা দেখা, অশ্লীল কিছু দেখা, গেইম-খেলায় আসক্ত থাকা, টিকটক-বিটিএস ফিতনায় আক্রান্ত থাকা, গীবত ইত্যাদি। এ মাসে শয়তান বন্দি থাকে। তাই দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করো এসব থেকে মুক্তির জন্য। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও, সাহায্য চাও। তিনি আল-গাফুর, আল-গাফফার।

ভাইয়া/আপু,

দেখো, তোমরা অনেক কষ্ট করে সাওম রাখো। কিন্তু তোমাদের অনেকেই সাওমের সময়টা পার করো মুভি দেখে, গান শুনে বা একটার পর একটা টিকটক দেখে, অন্যের গীবত করে। এগুলো যে সাওমকে হালকা করে দেয়, সেটা তো আর বলে দিতে হবে না, তুমি ভালোমতোই জানো। এখন দেখো, এমন আচরণ সম্পর্কে মুহাম্মাদ ﷺ কী বলেছেন—

‘এমন অনেক সায়িম আছে, যার সাওম থেকে প্রাপ্তি হচ্ছে শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। তেমনি কিছু মুসল্লি আছে যাদের সালাত কোনো সালাত-ই হচ্ছে না। শুধু যেন রাত জাগছে।’[5]

‘যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না, আল্লাহ তাআলার কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ [6]

তাহলে এবার একটু চিন্তা করে দেখো, তুমি শুধুই ক্ষুধার কষ্ট করবে কি না?  

  • অনলাইনকে নির্বাসনে পাঠাও

রমাদানের প্রতিটি মুহূর্ত অনেক মূল্যবান। সময় নষ্ট করাটা অনেক বোকামি হবে। কিন্তু অনলাইনে আমাদের প্রতিদিন কত সময় নষ্ট হয়ে যায়, তাই না? রাতে ঘুমাতেও দেরী হয়। তাই চ্যালেঞ্জ নাও, অনলাইনে কাটানো সময় কমিয়ে দেবে এ মাসে।

আগে ২ ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করলে এখন ১ ঘণ্টা করো। আগে ১ ঘণ্টা করলে এখন ৩০ মিনিট। আগে ৩০ মিনিট করলে এখন প্রয়োজন ছাড়া একবারও না।

দরকার হলে এ মাসে ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ো না। আর ফোন ব্যবহার করার জন্য তোমার মন আকুপাকু করতে পারে অনেক। এ জন্য সবচেয়ে ভালো হয় প্রয়োজন ছাড়া ফোন বন্ধ করে আম্মু-আব্বু বা বড় ভাইবোনের কাছে জমা দিয়ে রাখলে।

আর যদি তুমি চ্যাম্পিয়ন হতে চাও, তাহলে অনলাইন থেকে একেবারেই নির্বাসন নাও। ফেসবুক, টিকটক, ফ্রি ফায়ার—যা আছে সব আনইন্সটল করে দাও।

  • রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ো

অনেকেরই একটা বাজে অভ্যাস দেখা দেয় রমাদানে। রাতে না ঘুমিয়ে একেবারে সাহরি খেয়ে ঘুমানো। এর ফলে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়। তা ছাড়া রাত জেগে থাকার সময়টা মুভি, গান, সিরিয়াল বা বন্ধুদের সাথে অর্থহীন অনলাইন আড্ডায় চলে যায়। রমাদান মাসেও খুব খারাপ গুনাহ হয়ে যায়। তাই তারাবীহ পড়েই দ্রুত ঘুমিয়ে যাও।

  • আয়ত্ত করো দুআর হাতিয়ার

দুআ সারাবছরই কবুল হয়। তবে রমাদানে দুআ কবুল হয় সবচেয়ে বেশি। আর আল্লাহ তো এমনিতেই তার বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।[7]

তাই দুআ কবুলের প্রহরগুলোতে বেশি বেশি দুআ করো। ফরয সালাতের পর, আযান ও ইকামাতের মাঝখানে, ইফতারের আগে ইত্যাদি সময়ে।

তবে দুআর জন্য সেরা প্রহর হলো শেষ রাত। শেষ রাতের দুআ এমন এক শক্তিশালী তিরের ন্যায়, যা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। প্রতিদিন রাতের শেষভাগে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। বান্দাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতে থাকেন, 

‘কেউ কি আছে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দেবো। কেউ কি আছে আমার কাছে দুআ করবে, আমি তার দুআ কবুল করব। কেউ কি আছে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’[8]

এভাবে ফজর পর্যন্ত তিনি বলতেই থাকেন। তাই ওই সময়ে বেশি বেশি দুআ করো। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার জন্যই দুআ করো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুলুমের শিকার মুসলিম ভাইবোনদের জন্যও দুআ করো।

ছোট্ট একটা টিপস দিই এই ফাঁকে, ৩০ দিনের জন্য ৩০টি দুআর লিস্ট বানিয়ে ফেলো। অন্যান্য দুআর পাশাপাশি ঐ দিনের জন্য নির্দিষ্ট দুআ বেশি করে করলে। এর ফলে আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে ভুলে গেলাম—এই ঝুঁকি আর থাকে না, লিস্ট করাই আছে। ও হ্যাঁ, আমাদের ষোলো টিমের জন্য দুআ করতে ভুলে যেয়ো না যেন—আল্লাহ যেন আমাদের সর্বোত্তম রিযক দান করেন, দ্বীনের জন্য কবুল করে নেন।  

  • পরিবারের কাজে সহযোগিতা করো

অনেকেই ভাবে, শুধু সালাত, সাওম আর তিলাওয়াত-ই দ্বীন। পরিবারের খিদমাত করা, তাদের সাথে সদাচার করা মনে হয় দ্বীনের কিছু না। এটি পুরোপুরি ভুল ধারণা। নবিজি ﷺ  তো বলেই দিয়েছেন, 

‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।’[9]

তাই ভাইয়া এবং আপুরা, পরিবারের সদস্যদের প্রতি রহম-দিল হও। রমাদানের বরকতময় দিনগুলোতে যথাসাধ্য তাদের খিদমাত করো। ঘরের কাজে, রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করো। বাজারের কাজে বাবাকে সাহায্য করো। ঘরের কাজে সাহায্য করা নবিজি ﷺ-এর সুন্নাহ। মর্যাদাপূর্ণ কাজ। তাহলে তোমরা পিছিয়ে থাকবে কেন?

  • ইফতার হোক সাদামাটা

একটা বাজে কালচার তৈরি হয়েছে আমাদের সমাজে। ইফতারিতে বাহারি আইটেম না-থাকলে মন ভরে না। ভাবখানা এমন—সারাদিন কিচ্ছু খাইনি, এখন শুধু খাইতেই হবে আর খাইতেই হবে! এটা কি সাওমের শিক্ষা? সাওম তো আমাদের সংযমী হতে শেখায়। কথাবার্তা, চালচলন, খাওয়াদাওয়া সবক্ষেত্রে।

বাহারি আইটেমের ইফতার তৈরিতে আমরা নফসের গোলামি আর টাকা অপচয় করা ছাড়া কিছুই করি না। আবার ঘরে এত এত আইটেমের ইফতার তৈরি করতে গিয়ে দিনের বড় একটা অংশ রান্নাবান্নাতেই কেটে যায় মায়েদের। ইবাদাতের জন্য সময় বের করতে হিমশিম খান তারা।

রমাদান বেশি বেশি আমলের মাস। বেশি বেশি খাওয়ার মাস না। নফসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মা–বোনদের ইবাদাত থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। তাই ইফতার হোক সাদামাটা, আমল হোক বেশি বেশি। চাইলে ইফতারের বাহারি আইটেমের খরচ বাঁচিয়ে সে টাকা কোনো অসহায় সায়িমকে (রোযাদারকে) দান করতে পারো। 

নবি ﷺ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সায়িমকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে; সায়িমের সাওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।’[10]

  • শেষের দশে থাকো শীর্ষে

রমাদানের প্রত্যেকটা দিনই বরকতময়। এর মধ্যে শেষের দশদিনের রাতগুলো সবচেয়ে বেশি বরকতময়। এ সময় নবিজি (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবাদাতের জন্য কোমর বেঁধে নামতেন।[11] এই শেষ ১০ দিন চেষ্টা করবে একটু বেশি আমল করতে। যদি সম্ভব হয় অনলাইন থেকে একেবারেই বিদায় নেবে। আর যদি তুমি আরও বেশি আমল করতে চাও, তাহলে মাসজিদে (ছেলেদের জন্য) ইতিকাফে বসতে পারো।

  • সহস্র মাসের চেয়েও সেরা রাতের আবিদ হও

রমাদানে রয়েছে এমন এক বরকতময় রাত, যা সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। তা হলো, লাইলাতুল কদর। কুরআন নাযিলের রাত। এই রাতের ইবাদাতে বান্দাকে মাফ করে দেন মহিমাময় আল্লাহ। নবিজি ﷺ বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে সালাত আদায় করবে, তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।’[12]

তাই সহস্র মাসের চেয়েও সেরা এই রাতের আবিদ হও। জীবনের সেরা আমল করো এই রাতে। লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য শেষ দশদিনের প্রতিটি রাতই ইবাদাত করো; বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে।[13] শুধু সাতাশ তারিখের অপেক্ষায় থেকে অন্যান্য রাতে গাফলতি কোরো না। কেননা, লাইলাতুল কদর শেষ দশদিনের যেকোনো রাতেই হতে পারে। যে রাত হাজার মাসের চাইতেও দামী, এমন মহান রাত পাওয়ার জন্য একমাস জাগতে হলে সেটাও তো কম হয়ে যায়। তাই এর জন্য দশ রাত জাগাকে কঠিন ভেবো না। লাইলাতুল কদরের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হোয়ো না।

‌‘যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে মূলত সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো।’[14]

সব রাতেই বেশি বেশি আমল না করতে পারলেও অল্প করে কিছু কিছু আমল করো। যেমন- দু রাকাত সালাত আদায় করা, ১০ টাকা দান করা, ১ পৃষ্ঠা কুরআন পড়া। তাহলেও ইনশাআল্লাহ, বিপুল সাওয়াব লাভ করবে।

  • বিদায়ের আগে

রমাদানের শেষ দিকে ঈদের কেনাকাটায় অপচয় থেকে বেঁচে থাকবে। তুমি যদি আগে দুইটি পোষাক কিনতে, এবার একটা কেনো। আর একটার টাকা কোনো অভাবীকে দান করে দাও।  মার্কেটে গেলে নজরের হিফাযত করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায়। পারলে রমাদানের আগেই কেনাকাটা সেরে ফেলো।  

রমাদান শেষ হওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসেব নাও। জান্নাতের পথে কতটুকু এগিয়ে গেলে আর জান্নাতের পথের প্রতিবন্ধকগুলোর কী কী তোমার মধ্যে রয়ে গেছে, এগুলোর একটা লিস্ট করো। কোনো মুসলিমের প্রতি মনের কোণে ঘৃণা বা বিদ্বেষ থাকলে তা মুছে ফেলো। ভুলটা তাদের হলেও তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহও তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। সবাইকে মাফ করে দিয়ে একটা ফ্রেশ, পরিচ্ছন্ন অন্তর নিয়ে রমাদান শেষ করো।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সবাইকে রমাদানে ও রমাদানের বাহিরে অধিক পরিমাণে সাওয়াবের কাজ করার এবং তাঁর দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।


[1] বুখারি, ১৯০১; মুসলিম, 760।

[2] এই মাসে কী কী আমল করবে, তার একটি তালিকা দিচ্ছি আমরা। এটা অনুসরণ করলে সুন্দর একটি রমাদান কাটাতে পারবে ইনশাআল্লাহ—ষোলো ভাইয়া।

[3] মুসনাদু আহমাদ, 8507, সুনানু দারিমী, 1476।

[4] সূরা রা’দ, ১৩ : ২৮।

[5] মুসনাদু আহমাদ, 9685; সুনানু দারিমী, 2762।

[6] বুখারি, 1903; সুনানু আবী দাঊদ, 23৬২; তিরমিযি, 707।

[7] তিরমিযি, 3872; সুনানু আবী দাঊদ, 1488; সহীহ ইবনু হিব্বান, 876।

[8] মুসলিম, 758; মুসনাদু আহমাদ, 7509।

[9] তিরমিযি, 3895, সহীহ ইবনু হিব্বান, 4177।

[10] তিরমিযি, ৮০৭; ইবনু মাজাহ, ১৭৪৬; মুসনাদু আহমাদ, 17033।

[11] বুখারি, 2024।

[12] বুখারি, ২০১৪; মুসলিম, 759।

[13] বুখারি, ২০১৭; মুসলিম, ১১৬৯।

[14] নাসাঈ, ২১০৬; ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ, ৮৯৫৯; মুসনাদু আহমাদ, ৭১৪৮।


by

Tags: