(১)
আশা আর রাহী দুই বোন। যদিও দুজনকে পাশাপাশি দেখলে চট করে বোঝা যায় না। আশা অসম্ভব সুন্দরী। গায়ের উজ্জ্বল রং ঠিকরে বেরোচ্ছে। বড় বড় চোখ, ঘন কালো চুল। যে কেউ এক দেখায় ওকে পছন্দ করে ফেলবে। রাহীর চেহারা সাদামাটা। চাপা গায়ের রং, চেহারাতে তেমন লাবণ্য নেই, মুখের গঠনও মনে রাখার মতো কিছু না। তবে সবমিলিয়ে একটা মায়াবী ভাব আছে। স্বভাবেও দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। বড় বোন আশা নদীর মতো শান্ত, স্থির। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনোদিকেই মনোযোগ নেই৷ ক্লাসের সময়টুকু বাদে সারাদিন এ বই সে বই পড়ে দিব্যি সময় কাটিয়ে দেয়। আর রাহী ঠিক তার উলটো৷ একেবারে ঝড়ের মতোই উত্তাল, বেপরোয়া। পড়াশোনার ধারে কাছে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার প্রধান কাজ হলো আয়না দেখা। দিনের মধ্যে কমপক্ষে বিশ-তিরিশবার নিজের চেহারা দেখা চাই। শুধু চেহারা দেখলেও কথা ছিল৷ সারাক্ষণই ছুটছে। কখনো বন্ধুদের আড্ডায়, কখনো ভার্চুয়াল জগতে, কখনো মেইক আপ, কখনো শপিং।
কাজেকর্মে অমিল হলে কী হবে, দুই বোনের মধ্যে দারুণ ভাব। বাবা আফজাল সাহেব দুই মেয়ের মাঝে কোনোদিন তারতম্য করেননি। মা-মরা মেয়ে দুটোর জন্য তার স্নেহের কমতি নেই। অতি আদরেই কি না কে জানে, মেয়েদের মধ্যে বাবার প্রতি কোনো ভয় তৈরি হয়নি। শাসন কী জিনিস ওরা চোখেই দেখেনি কখনো। এর ফল হলো, অল্প আঘাতও ওদের সহ্য হয় না। ক্লাসের টিচার বকা দিলে কেঁদে বুক ভাসায়। ভাগ্য ভালো যে, ওদের ক্লাসে স্যার-ম্যাডামরা কাউকেই তেমন বকাবাজি করেন না।
রাহী কলেজে উঠার পর থেকে ক্লাসেও সেজেগুজে যায়৷ মাঝেসাঝে সে সাজকে বেশ উগ্রই বলা চলে। আফজাল সাহেবের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েছে, তারা ছোট থাকতে এভাবে ক্লাসে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না! আশা-রাহীর মা-ও নিজেকে পরিপাটি রাখতে খুব ভালোবাসতেন, তবু তিনি মার্জিত পোশাকের বাইরে কিছু পরতেন না। স্ত্রী গত হওয়ার পর থেকে দুই মেয়েকে তিনি একইভাবে বড় করেছেন। কই, আশা তো এমন হয়নি! রাহীটা এত অন্য রকম হয়ে গেল কেন বুঝে পান না তিনি। কিন্তু বাড়ন্ত মেয়েকে লজ্জায় কিছু বলতেও পারেন না। তা ছাড়া মেয়েদেরকে ছোট থেকেই সবসময় ইচ্ছামতো চলতে দিয়েছেন, এখন এসে সে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, রাহী কয়েকজন ছেলে বন্ধুর সাথে গাড়ি করে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলেছিল, আজ একটা বার্থডে পার্টি আছে পাপা। তিনিও বরাবরের মতো সায় দিয়েছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে উদ্বেগ তাকে ছেঁকে ধরল। মেয়েটা ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, তবু বাবার মন কন্যার বিপদের আশঙ্কায় কেমন দুরুদুরু করতে লাগল।
(২)
দু বোন কোথাও ঘুরতে গেলে সবাই যে আশাকেই ঘুরে ঘুরে দেখে, এটা রাহীর নজর এড়ায় না। এত সুন্দরী কেন আশা? বড় বোনকে মাঝে মাঝে খুব হিংসা হয় ওর। ইশ, সে-ও যদি এত সুন্দরী হতে পারত! আজকাল অবশ্য চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি। আগেও সাজগোজ করত, ইদানিং আরও বেড়েছে। সামনা-সামনি আশার মতো প্রশংসা না পেলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে ওর বিরাট ফ্যানবেইজ। টিকটক আর ইন্সটাগ্রামের সুবাদে এখন ওর লাখ লাখ ফলোয়ার। হাজারো মেয়ে ওর কাছে মেইক-আপ টিপস চায়। কোথায় কোন মেইক-আপ করতে হবে, কোন জামার সাথে কোন লুকটা মানাবে, ইন্সটাগ্রামে কোন ফিল্টার দিয়ে ছবি এডিট করতে হবে সব তার নখদর্পনে। কত ছেলে ওর জন্য পাগল! এক ডাকে মরতে রাজি। ব্যাপারটা রাহী বেশ উপভোগ করে। হাজার হোক, প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে! আশা এমনিতে যতই প্রশংসা পাক না কেন, ইন্সটাগ্রামে ওর এত ফলোয়ার নেই, এটা ভাবলে চেহারা নিয়ে রাহীর কষ্ট কিছুটা হলেও কমে।
লাইকের সংখ্যার সাথে সাথে রাহীর লুকস নেওয়ার পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। একদিন পার্টি লুক তো আরেকদিন ভ্যাম্পায়ার লুক! সেদিন একটা ওয়েস্টার্ন লুক নেওয়ার জন্য পার্লার থেকে মাথার একপাশের চুল চেছে ফেলল। অন্যপাশের চুল করে ফেলল উজ্জ্বল নীল। চোখ-ধাঁধানো নীল চুল, গায়ে ফ্যাশন কোট, ঠোঁটে ফেইক রিং লাগিয়ে যখন ভিডিও ছাড়ল, সবাই খুব বাহবা দিচ্ছিল। ঠিক এমন সময়ই পাপা ঘরে ঢুকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। রেগে গেলেও পাপা চিৎকার চেচামেচি করেন না। কিন্তু মেজাজ যে খারাপ হয়েছে রাহী কি তা বোঝেনি! খাবার টেবিলে ঠিক মেজাজ বেরিয়ে এল।
পাপা রাহীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
আজকাল খুব ঘোরাঘুরি হচ্ছে। কাল যে ছেলেগুলোকে দেখলাম, ভালো ফ্যামিলির ছেলে বলে মনে হলো না।
অন্যদিন হলে হয়তো রাহীও হাসতে হাসতে বলতো, হ্যাঁ বাবা, ওরা সবগুলা এক একটা বদ। কিন্তু এই মুহূর্তে রাহীর মেজাজও চড়ে আছে। বাবা সবসময় ওর পিছেই লাগে। কই, আশার বান্ধবীদের নিয়ে তো কখনো কিছু বলে না? ধুম করে বলে বসল,
আমি দেখতে খারাপ দেখেই আমার বন্ধুদের পিছে লেগেছ তুমি। আশা ফর্সা তাই ওর কোনো দোষ নাই, না? যত দোষ খালি আমার? আমার বন্ধুরা খারাপ আর ওর বন্ধুরা খু-উ-ব ভালো?
আফজাল সাহেব নির্বাক হয়ে গেলেন। তার ছোট মেয়েটা একটু একরোখা তিনি জানেন। কিন্তু এভাবে তাকে যা-তা বলবে এতটাও আশা ছিল না। কিছু বলার আগেই রাহী এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গটগট করে নিজের ঘরে গিয়ে ধড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আফজাল সাহেব কিছুক্ষণ তড়িতাহতের মতো বসে রইলেন। এরপর মেয়ের ক্ষুধার কথা ভেবে আর বসে থাকতে পারলেন না। সোজা মেয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আশাও বাবার পিছু পিছু দাঁড়াল।
রাহী মা, খেতে আয়!
– না, আমি খাব না। ভেতর থেকে রাহীর বজ্রকণ্ঠ শোনা গেল। এর পরপরই কান্নার আওয়াজ।
আমি কি তোকে বন্ধুদের সাথে মিশতে মানা করেছি?
রাহী কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে কী বলল বাইরে থেকে তেমন বোঝা গেল না। আশা একটু রাগ হয়েই বলল, রাহী, তুই কোনো কিছু শোনার অবস্থায় নেই। তুই বের হ। আগে খেয়ে নে, বাবা তোর জন্য না খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
রাহী দরজা খুলল না। আশা নরম হয়ে বললেও হয়তোবা দরজা খুলত। কিন্তু আজ আশাও তাকে কথা শোনাচ্ছে! তার মনে হলো, পৃথিবীর কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ তার আপন না। মৃত মায়ের কথা ভেবে ভেবে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে খানিকক্ষণ কাঁদল সে, এরপর উঠে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। সাজতে শুরু করল। কাজল লেপ্টে চোখের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, ঠোঁটে কান্নার মতো এক চিলতে হাসি, কপালে মোটা সিঁদুর। ছবির ক্যাপশন দিলো ‘পারু’। সেই ছবিতে আধা ঘণ্টার মধ্যে দেড় লক্ষ লাইক পড়ল। রাহীর মনও আনন্দে নেচে উঠল। মনে মনে নিজেকে একটু ধমকে বলল, ইশ, কেন যে পাপাকে উলটাপালটা কথা বলে এত হার্ট করলাম! কাল সকালে উঠেই ‘স্যরি’ বলব।
(৩)
আশা মা, রাহী মা, জলদি রেডি হ। আমি পনেরো মিনিট পরেই বেরোব।
রাহী ফট করে বলে বসল,
বাবা, পনেরো মিনিটে পারব না। আধ ঘণ্টা লাগবে।
আশা চোখ কটমট করে তাকাল বোনের দিকে। ইশারায় চুপ করতে বলল।
ওদের বড় ফুপা ইন্তেকাল করেছেন কিছুদিন হলো। আজ সে উপলক্ষে দুআ-কালামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাবার মন রাখতে ওদেরও সঙ্গে যেতে হবে।
– মরাবাড়িতেও তোর সাজগোজ করা লাগবে?
ইশ আশা, কী যে বলিস না তুই! মরাবাড়িতেই তো এক্সট্রা কেয়ারফুলি সাজতে হবে!
– কী সাজবি শুনি?
একটা স্যাড অ্যান্ড সোবার লুক, ইউ নো! নাথিং মাচ। আয় না, তোকেও সাজিয়ে দিই। একদম হালকা করে…
– না বাবা, তুই-ই সাজ। আমার অত লাগবে না।
‘যাহ, ঢং’ বলে ব্যস্ত হাতে নিজেকে একটু সাজিয়ে নিল রাহী। মনে মনে খুব তারিফ করল নিজের। ও খেয়াল করেছে, সাজলে লোকে ওর প্রশংসা করবেই করবে।
ফুপুর বাসায় অনেক লোক গমগম করছে। পুরুষরা বেশিরভাগ ছাদে আর নিচে চলে গেছে। একজন হুজুর মাইকে সবাইকে দুআ পড়ার কথা অনুরোধ করছেন, নিজেও তিলাওয়াত আর দুআ-দরুদ পড়ছেন। আশার দিকে আড়চোখে তাকাল রাহী। দেখল, আশা ওর আঙুলের ভাঁজ ধরে ধরে মুখ বিড়বিড় করছে। কেমন করে যে আশা সবখানে খাপ খাইয়ে যায় রাহী ঠিক বুঝতে পারে না। রাহীর উশখুশ লাগছে। আগরবাতির গন্ধে বমি পাচ্ছে ওর। আশাটা একটু কথা বললেও হতো। মানুষের ভারি নিঃশ্বাস আর কিছুক্ষণ পর পর মহিলাদের কান্নায় বাতাসটা গুমোট হয়ে আছে।
টুপ করে মহিলাদের ভিড় ছেড়ে উঠে পড়ল রাহী। এরকম দমবন্ধ পরিবেশে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একেবারে কোণার বেডরুমটায় চলে এল। এই ঘরটায় লোকজন অপেক্ষাকৃত কম। পাশেই লাগোয়া বারান্দা, ঠান্ডা বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। মাঝ বরাবর একটা খাট। সেদিকে তাকিয়ে রাহীর চোখ আটকে গেল।
বিদেশি পুতুলের মতো একটা মেয়ে! কত বয়স হবে? ওদের সমানই বোধ হয়। কিন্তু এত সুন্দর! এত ভয়ংকর সুন্দর কোনো মানুষ হতে পারে! রাহীর মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের জন্য ওর শ্বাস আটকে গেছে। একমনে তিলাওয়াত করছে মেয়েটা। কী অপূর্ব সেই তিলাওয়াত! হুজুরদের কুরআন পড়াও তো এতক্ষণ শুনল। কেমন যেন মরামার্কা। এই মেয়েটার পড়ায় এক অদ্ভুত জীবন্ত সুর। একেবারে অন্তরে গিয়ে নাড়া দিচ্ছে। রাহীর হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠল৷
মেয়েটার সৌন্দর্যে একটা অপার্থিব ব্যাপার আছে। সাদা সুতির একটা কামিজেও কী যে মানিয়েছে মেয়েটাকে! মাথায় বড় ওড়না। খালি মুখ আর হাতের কবজি দেখা যাচ্ছে। রাহী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার যেন কোনো হুঁশ নেই। একনাগাড়ে পড়ছে তো পড়ছেই। হঠাৎ রাহীর চাচাতো ভাই তমাল ঘরে ঢুকল। কী রে রাহি, তুই কখন আসলি! তোকে তো দেখিই নাই! কই ছিলি?
তমালের আওয়াজে খাটে বসা মেয়েটা এক ঝটকায় মুখের ওপর ওড়না টেনে নিল। এরপর এক মুহূর্তেরও কম সময়ে কুরআনটা বন্ধ করে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
কীরে, কী হলো তোর? কথা বলিস না কেন?
তমালের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল রাহী।
ছাদে যাবি?
মাথা কাৎ করে সায় জানাল সে। কিন্তু ছাদে গিয়েও মাথায় ঘুরতে থাকল খাটে বসা মেয়েটার কথা।
ঐ রুমের মেয়েটা কে রে?
– কে?
ঐ যে, খাটে বসে কুরআন পড়ছে। আগে কখনো দেখি নাই ওকে।
– ও আচ্ছা! বিভার কথা বলছিস! ও ফুপার মামাতো ভাইয়ের মেয়ে। হেব্বি সুন্দরী!
হুম, সেই রকম সুন্দরী! ওর একটা ভিডিও ইন্সটায় দিলে মিনিটে ওয়ান মিলিয়ন ভিউস পড়ত!
– ও ইন্সটা ইউজ করে না। একদম অন্য রকম মেয়ে।
চাপা মারিস না, ইন্সটা ছাড়া কেউ আছে? বাট ওয়েট ওয়েট, তুই দেখতেসি খুব ইন্টারেস্টেড!
– আরে না! বললাম না ও অন্যরকম। কোনো ছেলের দিকে ঘুরেও তাকায় না.. ওরা লাস্ট উইক কানাডা থেকে আসছে ফুপার ডেথ নিউজ শুনে..
তাই নাকি? কানাডার মেয়ে এমন হয় তোরে বলসে..
– আল্লাহর কসম! আমাকে রূপম বলসে, তোর বিশ্বাস না হইলে ওরে জিজ্ঞেস কর।
এটা-সেটা কথায় সন্ধ্যাটা ভালোই পার হয়ে গেল। শুধু সবকিছুর ভেতর রাহীর মাথায় ঘুরেফিরে একটা চিত্রই বারবার ভেসে উঠছে। পরীর মতো একটা মেয়ে হুড়মুড় করে মুখের ওপর ওড়না টেনে নিচ্ছে.. আচ্ছা, এত সুন্দরী হয়েও কেউ কেন নিজেকে ঢেকে রাখতে চায়?
আচ্ছা, এত সুন্দরী হয়েও কেউ কেন নিজেকে ঢেকে রাখতে চায়?
(৪)
আশা, তুই দেখসিলি মেয়েটাকে?
– বললাম তো দেখি নাই। এই নিয়ে একশ বার জিজ্ঞেস করসিস একই কথা।
তুই যে কী না! সেদিন লিভিং রুম থেকে বেরই হইলি না।
– দুআ-কালাম রেখে তোর মতো ছাদে গিয়ে দাঁড়ায় থাকব না কি?
রাখ তোর দুআ, বিরাট হুজুরনি আসছে! এই আপু, তুই যা না একবার ফুপুর বাসায়। ঐ মেয়েটাকে একবার দেখবি। (আবদারের সময় হলে রাহী ওর বোনকে আপু বলে সম্বোধন করে।)
– না ভাই, অত শখ নাই। তোর মুখে শুনেই বুঝতে পারসি মিস ইউনিভার্স কুরআন পড়তেসিল। তোর ইচ্ছা হইলে তুই যা।
ধুর, তুই না কোনো কাজেরই না।
– ঐ মেয়েকে দিয়ে আমার কাজটা কী শুনি? পর্দা শিখব?
আরে না, একটু দেখতি কত সুন্দর! এত সুন্দর দেখলেও চোখের পুণ্য হয়।
এমন টিচারের ভঙ্গীতে রাহী কথাটা বলল যে, আশা তো বটেই, রাহী নিজেও খিলখিল করে হাসতে লাগল।
হাসতে হাসতেই আশা বলল, তুই পুণ্য কর। আমার দরকার নাই।
বিভা মেয়েটা রাহীকে প্রভাবিত করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিভার রূপ বেশি বিমোহিত করেছে, নাকি ওর আচরণ এটা নিয়ে সন্দেহ আছে।
রাহী সবকিছুতেই সাজগোজের একটা বাহানা খোঁজে। ও ঠিক করল, একদিন বিভার মতো সাজবে। সাদা সুতির জামা। কারুকাজহীন। সাথে লম্বা ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা থাকবে। মুখে কোনো মেইক-আপ থাকবে না। সদ্য ওযু করে আসা পবিত্র-পবিত্র একটা আভা থাকবে। ব্যস এটুকুই। একদম সিম্পল লুক।
দুদিন পরেই সুযোগ এসে গেল। আজ টিকটকে ট্রেন্ডিং হচ্ছে সিম্পল মিনিমালিস্ট লুক। আজকেই বিভার লুকটা নিতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়াল রাহী। ঝটপট ওড়নাটা দিয়ে মাথায় হিজাবের মতো পরে নিল। হালকা মেইক-আপ করা ওর বরাবরের অভ্যাস। কিন্তু আজ ভীষণ কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল। এই লুকটায় ওকে ন্যাচারাল থাকতেই হবে।
মুহূর্তের মধ্যে লাইক আর কমেন্টের বন্যা বয়ে গেল।
(৫)
‘এই কালা **, পর্দা করে টিকটক করিস, লজ্জা লাগে না!’
‘পেত্নীর মতো লাগতেসে তোমারে!’
‘আপু, ন্যাচারাল লুকে তোমাকে একদম ভালো লাগে না!’
‘ময়দা সুন্দরী!’
‘এতদিন মেইক-আপ দিয়ে ভূতনী সুন্দরী সাজছিল!’
‘বাসর রাতে জামাই দেখলে পালাইব!’
‘অ্যামাজনের বান্দর!’
প্রথম কয়েকটা নেগেটিভ কমেন্ট দেখে রাহীর মন খারাপ লাগছিল। এত জঘন্য কথা ওকে কেউ বলেনি। কিন্তু আস্তে আস্তে মন খারাপের বদলে রাগ হচ্ছে। রাগে ও লাইভ করতে বসল।
‘তোমরা কি মনে করো, মানুষকে যা খুশি তাই বলবা? না, আমি তোমাদের কোনো কমেন্ট পড়ব না। হাউ টু-ফেইসড পিপল ইউ আর! সারাক্ষণ কমেন্ট করো, আমি কত সুন্দর। আমার থেকে মেইক-আপ টিপস নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করো। আর এখন একটা লুক পছন্দ হয় নাই বলে আমাকে টিজ করছো! আমার চেহারা নিয়ে ফান করছো! তোমাদেরকেও কিছু দেখানোর ইচ্ছা নাই আমার। গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার..’
রাহী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। জেদের বশে ঠিক করল, এখন থেকে এভাবে হিজাব করে ও আরও দশটা ভিডিও বানাবে। প্রতিদিন নতুন নতুন ওড়না পরে ভিডিও ছাড়া শুরু করল রাহী।
ফলোয়াররা এই পোশাকে রাহীকে দেখে অভ্যস্ত না। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাহী পঞ্চাশ হাজার ফলোয়ার হারাল। অবাক হয়ে লক্ষ করল, যে ছেলেরা ওর নামে পাগল ছিল ওরাই এখন ওর ভিডিওর পরিবর্তে অন্য মেয়েদের ভিডিওতে লাইক দিচ্ছে। অথচ ও এখনো আগের মতোই আছে। একই মানুষ। মানুষ যে ওকে না, ওর সুন্দর সাজকেই ভালোবাসে বুঝতে আর বাকি রইল না।
কিন্তু মানুষকে এর উপযুক্ত জবাব ও দিয়েই ছাড়বে। ভীষণ জেদ রাহীর। প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে ওড়না মাথায় দিয়েই সে সবখানে যাবে।
মনে হয়, আয়নাটাও ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
(৬)
আয়নার সামনে দাঁড়ালেও আজকাল রাহীর চাপা ব্যথা অনুভব করে। মনে হয়, আয়নাটাও ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেইক-আপ প্রডাক্টগুলো ওকে নিয়ে টিটকিরি মারছে। পুরো পৃথিবীর সবাই ওর স্বাভাবিক প্রসাধনহীন চেহারার দিকে আঙ্গুল তুলে আজেবাজে কথা শোনাচ্ছে। বিভীষিকার মতো অনুভূতি হয় ওর।
আশা, একটা কথা বল তো। আমি যদি আরেকটু সুন্দর হতাম, তাহলে কি আজকে আমাকে নিয়ে এত হাসাহাসি করা হতো?
আশা চুপ করে থাকে। প্রাণের চেয়েও আপন বোনটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ওর জানা নেই। রাহী এমন একটা জগৎ নিয়ে অস্থির হয়ে আছে, যেখানে সবকিছুই মেকি। এখানে কেউ কারও পরোয়া করে না। কেউ কাউকে ভালোবাসে না। এই বাস্তবতাটা ও রাহীকে কীভাবে বোঝাবে?
আশার নীরবতাকে রাহীর অসহ্য বোধ হয়। দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে, কথা না বললে আমার ঘরে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। আশা ধীরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়।
রাহী এতক্ষণ বহুকষ্টে কান্না চেপে রেখেছিল৷ বড় বোন বের হওয়ার পর প্রাণপণ কাঁদতে থাকে। ছোট বোনের কান্নার শব্দে আশারও বুক ভারী হয়ে আসে। যদি চেহারা বিনিময় করার কোনো সিস্টেম থাকত, তা হলে সে তার একমাত্র বোনটাকে অনায়াসে নিজের চেহারা দিয়ে দিত। কিন্তু এমন কোনো সিস্টেম পৃথিবীতে নেই। অবুঝ মেয়েটাকে ও কী দিয়ে সান্ত্বনা দিবে!
বাবাকে রাহীর কাছে পাঠায় আশা। আফজাল সাহেবও মেয়ের কষ্ট দেখতে দেখতে মুষড়ে পড়েছেন। এমন প্রাণচঞ্চল মেয়ে নিজেকে নিয়ে এত কষ্ট পাচ্ছে মেনে নেওয়া যায় না। রাহীর মাথায় আলতো করে হাত রাখেন তিনি। মন খারাপ করিস না রে, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। টিকটক আর ইন্সটাগ্রামে রাহীর র্যাংকিং কমতে থাকে। সারাবছর টপ ভিউ পাওয়া সত্ত্বেও এই অল্প কয়দিনের লো ভিউয়ের জন্য বছরের সেরা পাঁচ ইয়াং মেইক-আপ আর্টিস্টদের তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে যায়। কেউ ওকে ভালোবাসে না। কেউ ওকে প্রশংসা করে না। রাহীর ইচ্ছা করে, আত্মহত্যা করবে। বিভার মতো ও কোনোদিন হতে পারবে না।
একটা মেয়ের জীবনে তাকে সুন্দর লাগছে শুনতে পারাটা যে কী অসামান্য আনন্দের, সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হলে তা কেউ জানবে না। ছোটবেলা থেকে কেউ ওকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি। কেউ আগ বাড়িয়ে সুন্দর বলেনি। দিনের পর দিন মেইক-আপ টিউটোরিয়াল ঘেটে, নিজে নিজে মেইক-আপ শিখে, বহু কষ্ট আর সাধনা করে ও আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল। ভার্চুয়াল জগতে সবাই ওর রূপের প্রশংসা করত। ওকে ঘিরে কত আলোচনা চলত। ও ছিল হাজারো কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু। এত বছরের সাধ শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে সব হারিয়ে গেল। সবাই পর হয়ে গেল। ইশ, একটু সুন্দর যদি হতে পারত সে! আর একটু বেশি সুন্দর!
(৭)
রাহী নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে। ওর কিছুই ভালো লাগে না। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। সারাদিন চুপচাপ নিজের ঘরে পড়ে থাকে। জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে নিজেকে উদভ্রান্তের মতো লাগে ওর।
আশা কী একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে রাহীকে বলল, তোর জন্য একটা গিফট আছে। দেখবি?
র্যাপিং পেপারে মুড়ানো একটা চারকোণা বাক্স এগিয়ে দিল ওর দিকে।
কাগজটা খুলে রাহী দেখল, একটা আয়না। বলল, নিয়ে যা, আমার লাগবে না।
– কেন, তোর ভালো লাগেনি?
হুম, সুন্দর।
– আয়নায় তাকিয়ে দ্যাখ রাহী, আজকে তোকে খুব সুন্দর লাগছে! এই বলেই আশা বেরিয়ে গেল।
দীর্ঘ দশ দিন পর আয়নার দিকে তাকায় রাহী। দীর্ঘ দশ দিন! ভাবা যায়!
অল্প কয়দিনেই চোখের নিচে কালি পড়েছে। গাল দুটো ভেঙে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। একটু কাজল লাগাতেও আজকাল ইচ্ছা করে না। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো, ও বিভাকে দেখতে পাচ্ছে। কী পবিত্র একটা চেহারা। কী অপূর্ব সেই চেহারার জ্যোতি। পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর! অবাক হয়ে ভাবল রাহী, এত সুন্দর! তবে কেন ছেলেদের সামনে মুখ পর্যন্ত দেখায় না মেয়েটা? ওর কি নিজের প্রশংসা শোনার ইচ্ছা হয় না?
ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবল রাহী। ওর মনে জমে থাকা অজস্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল এতদিন পর। মুখের ওপর ওড়না চেপে চকিতে দেয়ালের দিকে ফিরে যাওয়ার দৃশ্যটা আবার মনে পড়ে গেল ওর।
বিভার মতো একটা বড় ওড়না জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রাহী। বৈশাখের আকাশে কালো মেঘ জমেছে। ঝড় হবে বোধ হয়।
কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও যা করবে বলে ভাবেনি, আজ সেটাই করে রাহী। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার সাথে সাথে সে-ও টুপ করে তার অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দেয়। আজ বহুদিন পর তার খুব ভালো লাগছে। পাখির মতো হালকা লাগছে নিজেকে।
চোখেমুখে বৃষ্টির পানি মাখতে মাখতে রাহী ভাবে, ঝড় হয় হোক, বৃষ্টি নামুক। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক। ফেলে আসা পথ সে আর কখনো মাড়াবে না।