নীড়ে ফেরার গল্প

অন্ধকারকে আলো ভেবে জড়িয়ে ধরা ছেলেটার গল্প এটি। মরীচিকাকে সে ছুঁতে চাইত, মিথ্যাকে আপন ভেবে গায়ে মাখাত, বুকের মধ্যে পুষে রাখত অভিশপ্ত এক জঞ্জালকে।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের ‘ছেলেটা’ ভালো স্টুডেন্ট ছিল। একেবারে মায়ের চোখের মণি। মা তাকে চোখের আড়াল করতে দিত না। সন্ধ্যায় যখন সে বন্ধুদের সাথে খেলার পরে মাগরিবের সালাত পড়তে যেত এবং ফিরতে একটু দেরি হতো, বোরকা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ত মা, সাথে থাকত একবুক হতাশা আর ছেলে হারানোর ভয়।

ছেলেটা একটু বড় হলো, স্কুলে ভর্তি হলো। কী কান্নাটাই-না কেঁদেছিল সেদিন। ছেলেটার কান্না গিয়ে ধাক্কা দেয় একজন স্যারের বুকে। ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলেন সোফার বালিশের মতো। হাতে গুঁজে দিলেন কিছু টাকা। আল্লাহ স্যারটাকে ভালো রাখুক সবসময়। দুবছর পড়ার পর ছেলেটা এল নতুন স্কুলে। নতুন মানুষ। নতুন পরিবেশ। ছেলেটা পরিচিত হয় ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটার সাথে। কিছু বন্ধু তৈরি হয় তার। কত্ত সুন্দর জীবন যাচ্ছিল তার…

হাইস্কুলে পা রাখল ছেলেটা। নতুন নতুন গোঁফ গজানো শুরু হলো। বুক উঁচিয়ে চলার প্রবণতা বাড়ল। দুনিয়াটাকে নিজের মতো বানাতে শুরু করল আমাদের গল্পের হিরো। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি জন্মাল আকর্ষণ। নেতিবাচক জিনিস জানার আকাঙ্ক্ষা তাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে নিয়েছে তার আট পায়ে। ছোটবেলা থেকেই টিভিতে বাংলা ছবি দেখত সে। একটা সময় বুঝে উঠে, জীবনকে আরও সুন্দর করতে হলে দরকার একজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ। সে ডুবে থাকতে লাগল অবাস্তব সব কল্পনায় – এদিকে মা-বাবা একের পর এক লড়ে যাচ্ছে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্যমে।

হাইস্কুলের বন্ধুগুলোকে বড্ড স্মার্ট মনে হতো। কত্ত আধুনিক ওরা। কথায় কথায় গালি আওড়াতে পারে। হিন্দী গান বুঝে – আবার গাইতেও পারে। ছেলেটা তাদের সান্নিধ্যে আসলো। লুফে নিল সেই আকাঙ্ক্ষিত(!) গালিগুলো। এখন সেও গালি দিতে পারে। জীবনের ওপর যে সাদা-কালোর পরতটা ছিল, সেটা সরে যাচ্ছিল দিনদিন। আহা, কত্ত সুন্দর এই পৃথিবী!

একদিন বাসার ছাদে আমাদের ‘ছেলেটা’ আবিষ্কার করে বসে এক নতুন জিনিস। অভিশপ্ত এক জিনিস। যেটা নষ্ট করে একজন মানুষকে, একটা পরিবারকে, একটা জাতিকে। মোবাইল ফোনে অশ্লীলতায় ডুবে থেকে বড্ড আনন্দ হতো ছেলেটার। তবে একটু একটু করে পাওয়া এই সাময়িক সুখ বাড়াচ্ছিল হতাশা, গ্লানি আর পরনির্ভরতা। খুব হতাশায় ভোগা শুরু করল সে। মেজাজ সবসময় খারাপ থাকত। মায়ের সাথে ভীষণ দুর্ব্যবহার করত। গালিগালাজ করত। আমাদের ছেলেটা বদলে গেল। ডুবে গেল অন্য এক জগতে। সেখানে আছে অশ্লীলতা, মিউজিক, মুভি।

ছেলেটার বন্ধুত্বের খাতায় যোগ হয় কিছু নতুন বন্ধু। কোনো একসময় সে পরিচিত হয় নতুন এক মেয়ের সাথে। কিন্তু বন্ধু হিসেবে। মেয়েটার পাশে যতক্ষণ সে থাকত, তার হার্টবিট বাড়ত শুধু। সে চাইত মেয়েটা তার হাত ধরুক। সারাক্ষণ তার সাথে কথা বলুক। কিন্তু, সে এই সম্পর্কটাকে (না কি বেহায়াপনা?) নাম দিয়েছে ফ্রেন্ডশীপ। দুজনে প্রাইভেট পড়ত একসাথে। একদিন প্রাইভেট পড়তে গিয়ে সে জড়িয়ে যায় এক অভিশাপের সাথে, এক পাপাচারের সাথে। সুযোগ পেলেই সে এই পাপটা করত। জীবনের অর্থ বদলে গেল তার। মরীচিকাটাকে সে সত্যি ভাবতে শুরু করল।

ততদিনে তার ঈমান খুব ভালোভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে। সারাদিন মিউজিক নিয়ে থাকত, রাত জেগে মুভি দেখত। ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমিকার সাথে কথা বলত। তেমন কোনো বিধিনিষেধ না থাকলে, শুক্রবারেও মাসজিদে যেত না আমাদের হিরোটা। বহুবার সে ‘প্যান্ট নাপাক’ বলে ফিরে এসেছে মাসজিদের সামনে থেকে। তার বন্ধুরা সালাত পড়ত, ইচ্ছে করেই সে দাঁড়িয়ে থাকত মাসজিদের বাইরে। মনে মনে গাইত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন নামকরা ব্যান্ডের গান। একসময় তার মধ্যে চলে আসে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। মা-বাবার সাথে রাগারাগি করা নিত্যদিনের রুটিন। মাঝেমাঝে সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েটাকে ছেড়ে যাবার। কিন্তু পারে না। মেয়েটা একবার জড়িয়ে ধরলেই সে ভুলে যেত পুরোনো সব সিদ্ধান্তগুলো।

ছেলেটা এসএসসি দিল, দেখাদেখি করার অভ্যেসটা এবারও তাকে এনে দিল ভালো রেজাল্ট। এলাকায় ভালো কলেজ না থাকায় পাড়ি দিল ঢাকায়। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল মা-বাবার স্বপ্ন। আবারও ডুবে যেতে লাগল মিউজিক, মুভি, অশ্লীলতা এবং গোপন পাপে। রাতদিন হতাশ থাকত। আত্মবিশ্বাস বলে কিছু ছিল না। বাড়ি থেকে মা-বাবা ফোন করলে অসহ্য মনে হতো। সারাদিন কাটাত শুয়ে-বসেই। আলসেমি করে। মন খারাপ করে। মাঝে মাঝেই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করত।

একদিন আমাদের ‘ছেলেটা’ তার আরেক বন্ধুকে নিয়ে যায় নীলক্ষেতে। উদ্দেশ্য বই কেনা। নীলক্ষেত থেকে একটু দূরেই বাটা সিগন্যাল থেকে সামান্য হাঁটলেই অন্য বন্ধুর বাসা। ভূত চাপল সেদিনের রাতটা তাদের বাসায় থাকার। প্রচুর আড্ডা দেওয়া যাবে, গানবাজনা হবে, পঁচানো হবে একে অন্যকে। বাসায় এসেই কতক্ষণ আড্ডা দিল তারা। আড্ডার এক পর্যায়ে তার এক বন্ধু তাকে অশ্লীলতার খারাপ দিক নিয়ে একটি ভিডিও দেখায়। খুব মনযোগ সহকারে ভিডিওটি দেখে সে। তার মস্তিষ্কের ডোপামিনগুলো ক্রমশ ছোটাছুটি করছিল। কিছু একটা তাকে তাড়া দিচ্ছিল। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সব মিথ্যে ছিল তার অতীত। সে নিজেকে নীচ ভাবতে শুরু করল।

বাসায় ফিরে পরের রাতটা সে পুরোটা কাটিয়ে দিয়েছিল ইউটিউবে ইসলাম নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। জাহান্নামের ভয়াবহতা নিয়ে একটা বয়ান শুনে তার লোম দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর দয়া ও রহমত নিয়ে আর একটা ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত নেয় নিজেকে পালটে ফেলার। আর কোনো অশ্লীলতা না। কোনো হারাম রিলেশন না। যে গানগুলো ছাড়া সে তার জীবনকে অর্থহীন মনে করত, এক ক্লিকেই ডিলিট করে দিল সব। অনেক হাল্কা অনুভব করল। সালাত পড়া শুরু করল। অনেকদিন পর হাতে নিল কুরআন। কম্বল ছেড়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু করে আদায় করে নিল জীবনের প্রথম তাহাজ্জুদ সালাত। অহংকারকে দমিয়ে রেখে শুরু করল টাখনুর ওপরে প্যান্ট পরা। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা ছেড়ে দিয়েছে এখন সে। মা-বাবার সাথে ডেইলি কথা না বললে কেমন যেন খালি খালি মনে হয় তার। আস্তে আস্তে সে জামাআতে সালাত পড়া শুরু করল। প্রেমিকার সাথে ব্রেকআপ করাটা খুব কষ্টকর হলেও করে ফেলল। প্রেমিকার সব স্মৃতি নষ্ট করে ফেলল। গিফট, ম্যাসেজ, ফেইসবুক পোস্ট, সেলফি, ভিডিও…সব। প্রেমিকা অনেক রাগ করল, কষ্ট পেল। তারপরেও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সে বুকে পাথর বেঁধে ব্রেকআপ করল। মাঝে মাঝে প্রেমিকার কথা মনে পড়ত তার। খুব কষ্ট হতো। কিন্তু জান্নাতের নিয়ামাতের কথা ভাবত সে তখন। ভাবত প্রেম করার সময়ে তার জীবনে কত হতাশা, অস্থিরতা ছিল! অতীতের সেই দুর্বিষহ সময়টার কথা ভাবলে তার মন শান্ত হয়ে যেত।

এখন তার জীবনে কোনো হতাশা নেই। মন খারাপ নেই। আত্মবিশ্বাস উপচে পড়ছে তার। এভাবেই চলতে থাকুক আমাদের ‘ছেলেটা’র জীবন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আলোর পথে ফিরিয়ে আনুক আমাদের সবগুলো ‘ছেলে’কে।

(লস্ট মডেস্টির ফেসবুক পেইজের ইনবক্সে এক ভাইয়ের শেয়ারকৃত সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ঈষৎ সংক্ষেপিত।)


Posted

in

,

by

Tags: