রাত ১০ টা পার হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। স্টেশনে বসে আছি। স্টেশন মাসজিদের সামনের এক বেঞ্চিতে। হাতে আধখোলা একটা বই। পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মন বসছে না স্টেশনের হট্টোগোলে। ঈশার জামাআত হয়ে গিয়েছে আগেই। স্টেশন মাসজিদের ছোট্টো গেটে তালাও ঝুলে গেছে। হটাৎ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ল। হন্তদন্ত হয়ে তিনি আমার দিকেই ছুটে আসছেন। কিছুটা অবাক হলাম। উনাকে তো চেনা মনে হচ্ছে না। ভদ্রলোক কাছে এসে আমাকে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন ‘ভাই, আপনার কাছে কি কোনো জায়নামায হবে?’
ভদ্রলোক ঈশার সালাত পড়বেন। কিন্তু জায়গা পাচ্ছেন না। মাসজিদ তো বন্ধ।
জায়নামায নিয়ে ঘুরার স্বভাব আমার নেই। ভদ্রলোককে হতাশ করতে হলো। পাশেই কিছু তাবলীগের মুরুব্বি ছিলেন। তাঁদের কাছে যেতে বললাম উনাকে। সেখানেও হতাশ হতে হলো। শেষমেশ, পাশের দোকান থেকে পুরোনো একটা কাগজের বাক্স নিয়ে সেটা ভাজ করে তার ওপরই সালাত আদায় শুরু করলেন। ট্রেন আসার অনেক দেরি ছিল। হাতে অফুরন্ত সময়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছিলাম আমি।
ভদ্রলোকের সালাত পড়া শেষ হলে উনি চলে গেলেন। আমিও কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তারপর হটাৎ খেয়াল করলাম সেখানে মানে সেই কাগজের বাক্সের জায়নামাযের ওপরে আরেকজন সালাত পড়ছেন।
মাথায় হঠাৎ করেই একটা চিন্তা আসল তখন।
প্রথম ভদ্রলোক জায়নামায বানিয়ে সালাত পড়েছিলেন। তার সালাত কবুল হতেও পারে নাও হতে পারে। তিনি সাওয়াব পেতে পারেন নাও পেতে পারেন। কিন্তু তার বানানো জায়নামাযে যত মানুষ সালাত পড়বে সেখান থেকে তিনি সাওয়াব পাবেন। (সালাত আদায়কারীদের সাওয়াব কমানো হবে না।)
যদি এখানে ১০০ জন মানুষ সালাত পড়েন, তাহলে ১০০ জন মানুষের সালাতের সাওয়াব তিনি পাবেন।
ভালো কাজের সূচনা করা খুবই সাওয়াবের কাজ। তুমি সেই কাজটি শুরু করার সময় হয়তো ভাবতেও পারবে না, এই কাজটি একসময় কী বিশাল এক কর্মযজ্ঞে পরিণত হতে পারে।
ভালো কাজ যত ছোটই হোক অবহেলা কোরো না
মুসআব ইবনু উমাইর রদিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা চিন্তা করো। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশে মদীনায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন উনি। উনার মাধ্যমে আউস এবং খাযরায গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। উনার হাতে ইসলাম কবুল করেন সাদ বিন মুয়ায রদিয়াল্লাহু আনহু-এর মতো মানুষ, যার মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় মুসআব রদিয়াল্লাহু আনহু-এর দাওয়াতের প্রভাবে মদীনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হিজরত করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। মদীনায় ইসলামের ঘাঁটি তৈরি হয়। এখান থেকেই ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
এবার একটু চিন্তা করো তো, মুসআব রদিয়াল্লাহু আনহু কী বিপুল পরিমাণ সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি যখন দাওয়াত নিয়ে মদীনায় এসেছিলেন, খেজুর বাগানে বসে বসে আউস বা খাযরায গোত্রের নেতাদের ইসলামের কথা শোনাচ্ছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন তাঁর এই ছোট ছোট কথাগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ এক বিপ্লবের সূচনা করছেন?
মানুষের উপকার করা, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা, দারোয়ানকে-রিকশাওয়ালাকে সালাম দেওয়া, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো, ক্ষুধার্তদের খাবার দেওয়া, সাধ্যমতো দান সাদাকাহ করা, বাসে বয়স্ক বা নারীদের জন্য সিট ছেড়ে দেওয়া, ফেইসবুকে ভালো পোস্ট লিখা, ভালো কোনো ভিডিয়ো বানানো, ইমেজ বানানো… আমরা ভালো কাজ করতে কখনো পিছপা হব না। সেই ভালো কাজ অনেক ছোট হলেও অবহেলা করব না। আমরা আসলে নিশ্চিত করে বলতে পারব না, এই ছোট ছোট ভালো কাজগুলো ফুলে ফেঁপে উঠে কী বিশাল কাজে পরিণত হতে পারে।
আবূ হুরায়রা রদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় পথে থাকা কাঁটাযুক্ত ডাল দেখতে পেয়ে তা সরিয়ে ফেলল। (এ কাজ আল্লাহর এতই পছন্দনীয় হলো যে) আল্লাহ তাআলা তার এ কাজ সাদরে কবুল করে নেন। তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’[1]
ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, সেই ব্যক্তিকে এই আমলের ওসীলায় জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে।[2]
তোমাদের আমার নিজের একটা ঘটনা বলি। আমি এক সময় বিভিন্ন কারণে হতাশায় ভুগছিলাম। একের পর এক সমস্যা আসছিল। একটার সমাধান হলে অন্যটা আরও জটিল হয়ে উঠত। কী করব বুঝে উঠতে পারতাম না। মন খারাপ করে বসে ছিলাম। আমার রুমমেট বলল- চল, ফুটবল খেলে আসি।
ফুটবল ভালো লাগত না। তারপরেও গেলাম। এক দেড় ঘন্টা ফুটবল খেলে ক্লান্ত হয়ে যখন রুমে ফিরছিলাম, তখন রুমমেট আমার ঘাড়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে বলল- এনাম, চিন্তা করিস না; আল্লাহ আছেন। আর তুই মেধাবী। বলতে গেলে আমাদের সবার চাইতে। একটা না একটা সমাধান বের হয়ে যাবে। (এই কথাগুলো লেখব কি না তা ভেবে অস্বস্তি লাগছিল। শেষমেষ লেখেই ফেললাম। নিজেকে বড় প্রমাণ করার ইচ্ছা থেকে নয়। কেবল তোমাদের বাস্তব অবস্থাটা বোঝানোর জন্য)
ওর কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। আল্লাহই সমস্যা সমাধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যে ভেঙ্গে পড়েছিলাম, কোনো কিছু করার আগ্রহ, উদ্যোম হারিয়ে ফেলেছিলাম তার অনেকটাই ফিরে এসেছিল তার ছোট ছোট এই কয়েকটা বাক্যে। সে জানতেও পারল না তার এই ছোট ছোট কয়েকটা কথা আমার জীবনে কতটা প্রভাব ফেলল।
চারিদিকে অন্যায়, যুলুম অসত্য আর অধর্মের ছড়াছড়ি। আমরা আশা হারিয়ে ফেলি। প্রতিবাদ করতে ভয় পাই। ভাবি, আমার এই মৃদু প্রতিবাদে কী-ই বা হবে। অযথা ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই। অথচ আমরা কিন্তু জানি না, আমার এই সামান্য প্রতিবাদেই অনেক কিছু বদলে যেতে পারে।
কোনো ভালো কাজকে ছোট ভাববে না।[3] যতই ছোট হোক করবে। তুমি জানো না এর শেষ কতটা মধুর হতে পারে!
***
[1] বুখারি, 652; মুসলিম, 1914
[2] মুসনাদু আহমাদ, 10432
[3] মুসলিম, 2626